আওয়ার টাইমস নিউজ:
স্টাফ রিপোর্টার: ২০২৪ সালের জুলাইয়ের উত্তাল আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ঢাকার উত্তরা, বিশেষ করে আজমপুরের বিখ্যাত বিএনএস সেন্টার এলাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের নারকীয় হামলার প্রতিবাদে দেশজুড়ে ছাত্ররা রাস্তায় নামলে উত্তরা পরিণত হয় আগুনঝরা আন্দোলনের মঞ্চে।
১৬ জুলাই থেকে টানা উত্তরে জড়ো হতে থাকেন স্কুল-কলেজ, মাদরাসা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ ও ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’—এই ধাঁচের স্লোগানে প্রকম্পিত হয় রাজপথ। সবচেয়ে ভয়াবহ দিনটি ছিল ১৮ জুলাই। এদিন শহীদ হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। স্নাইপারের গুলি কপালে বিদ্ধ হলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগে তার শেষ কথা ছিল, ‘পানি লাগবে, পানি’—যা আজও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
স্থানীয়দের মতে, পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, এপিবিএন, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা তখন ছাত্র-জনতার ওপর দমন-পীড়নে অংশ নেয়। উত্তরা, টঙ্গী ও গাজীপুরের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা প্রতিটি গলির মুখে অবস্থান নেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, প্রতিদিন আসরের আজানের কিছুক্ষণ পরই পুলিশ হঠাৎ করেই হিংস্র আক্রমণে নামে। যেন আজান ছিল তাদের দমন অভিযানের সংকেত।
১৯ জুলাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে উত্তরা হাউস বিল্ডিং এলাকা। গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, কাউন্সিলর শিপু খানসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ছাত্রদের প্রতিরোধে আহত হন। যুবলীগ নেতা জুয়েল মোল্লাকে গণপিটুনির পর গাছে ঝুলিয়ে রাখার খবর দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে।
এই সময় উত্তরা জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে আবদুল্লাহপুর, রাজলক্ষ্মী, জসিমউদ্দিন ও হাউস বিল্ডিং এলাকায়। ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলা এই আন্দোলনে শতাধিক নিহত ও কয়েকশ আহতের দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক তালহা সরদার (ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র) বলেন, “আমরা রাতেই ম্যাপ হাতে নিয়ে পরিকল্পনা করতাম, তারপর সকালের আলো ফোটার আগেই রাজপথে নেমে যেতাম।” তার দাবি, আন্দোলনের প্রাণ ছিলো মায়েরা—যারা নিজ সন্তানদের মৃত্যুর আশঙ্কা সত্ত্বেও রাজপথে পাঠিয়েছেন।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া লাবিব মোহন্নাত বলেন, “প্রথম দিকের আন্দোলনে ছাত্রলীগ তেমন সুবিধা করতে পারেনি। পরে পুলিশ যখন সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে, তখন পুরো এলাকার মানুষ একাট্টা হয়ে প্রতিবাদে নামেন।”
এই সময় পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, এপিবিএন, বিজিবি ও সেনাবাহিনী সংঘবদ্ধভাবে নির্বিচারে গুলি চালায়। উত্তরা আজমপুর এলাকায় ১৮ জুলাই নিহত হন অন্তত ৪ জন আন্দোলনকারী। আন্দোলনকারীরা পরে ১০২ জনের একটি প্রাথমিক মৃত্যুর তালিকাও প্রস্তুত করেন।
এই আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা। এক মা বাসার জানালা দিয়ে বার্গার ও পানি ছুড়ে দিচ্ছেন, অন্যজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলছেন, “লাশ হয়ে ফিরলেও চলবে, আন্দোলন ছাড়িও না”—এমন সব দৃশ্য আন্দোলনকে বেগবান করেছে।
আসরের আজান হয়ে উঠেছিল যেন ছাত্র হত্যার অশুভ সংকেত। দিনের পর দিন এই সময়টাতেই শুরু হতো গুলি, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটের বৃষ্টি। উত্তরা যেন এক রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল—যেখানে ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য, অধিকার আদায়ের জন্য।
cgt