আওয়ার টাইমস নিউজ।
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মুসলিম বিশ্বের শক্তি, ঐক্য ও গৌরবের প্রতীক হিসেবে একসময় যেসব আরব রাষ্ট্রের নাম উচ্চারিত হতো, আজ সেগুলোর বড় অংশ নিজেদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব ও মর্যাদা বিস্মৃত হয়ে পড়েছে পশ্চিমা আধিপত্যের ছায়াতলে। নামমাত্র স্বাধীনতার মুখোশ পরে আজ তারা মূলত বহির্বিশ্বের স্বার্থ রক্ষাকারী পুতুলশাসনে পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই বাস্তবতাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম Middle East Eye।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওসমানি সাম্রাজ্যের পতনের সময় থেকেই আরব ভূখণ্ডে এক নতুন ‘চক্রান্তের নকশা’ শুরু হয়, যার মূল নকশাকার ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ। সরাসরি শাসনের যুগ ফুরিয়ে আসছিল, তাই ব্রিটিশরা তৈরি করল ‘আরব মুখোশ’ একটি কাঠামো যেখানে শাসন করবে আরব নামধারী পুতুল, কিন্তু আদেশ-নির্দেশ আসবে ব্রিটিশ উচ্চপদস্থদের কাছ থেকে।
১৯১৬ সালের সাইক্স-পিকো চুক্তিতে ফ্রান্স ও ব্রিটেন গোপনে আরব ভূখণ্ড ভাগ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একই সঙ্গে ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্রিটেন প্রকাশ্যে সমর্থন জানায় যেখানে আরবরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, অথচ তাদের পরিচিত করা হয় ‘ইহুদিবহির্ভূত সম্প্রদায়’ হিসেবে।
ফলস্বরূপ, হাশেমি নেতা শরিফ হোসাইনের দুই পুত্র ফয়সাল ও আবদুল্লাহকে বসানো হয় যথাক্রমে ইরাক ও ট্রান্সজর্ডানের সিংহাসনে। মিসরের বাদশাহ ফুয়াদ, সৌদি আরবের ইবনে সউদ, তাঁরাও এই কাঠামোর অনুগত চরিত্র হয়ে ওঠেন। লেখক আমিন রিহানি একে আখ্যা দেন: “এরা উপনিবেশবাদের ক্রীড়ানক থেকেও বেশি, স্বাধীন নেতা থেকে কম।”
১৯৫২ সালে মিসরে গামাল আবদেল নাসের সামরিক বিদ্রোহ ঘটিয়ে ব্রিটিশপন্থি বাদশাহকে সরিয়ে দেন। একইভাবে ইরাকেও পতন ঘটে রাজতন্ত্রের। কিন্তু ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের জায়গা নেয় নতুন নিয়ন্ত্রক হিসেবে। তৈরি হয় ‘আরব মুখোশ ২.০’—এইবার তেলসম্পদ ও পশ্চিমে বিনিয়োগের বিনিময়ে আরব শাসকদের আনুগত্য নিশ্চিত করা হয়।
আজকের এই আরব শাসকেরা নিজ নিজ দেশের জনগণের চেয়ে পশ্চিমা শক্তির প্রতি বেশি অনুগত। ফিলিস্তিন প্রশ্নে তারা নির্লিপ্ত, বরং ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যবসা, নিরাপত্তা ও সামরিক চুক্তিতে আগ্রহী। ক্যাম্প ডেভিড, অসলো চুক্তি, এমনকি সাম্প্রতিক আব্রাহাম চুক্তিগুলো মূলত আরব বিশ্বের আত্মসমর্পণের দলিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে এই প্রতারক চক্রের বাইরে এখনো কিছু প্রতিরোধ অটুট আছে, গাজার হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ আন্দোলন। পশ্চিমা ঘনিষ্ঠ আরব রাষ্ট্রপ্রধানেরা এই প্রতিরোধকে দমন করতে ব্যস্ত, আবার কেউ কেউ ইসরায়েলি অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করতেও দ্বিধা করছেন না।
আজ গাজার রক্তপাত, ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ ও পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে আরব জনগণের মনে যে ক্ষোভ জমছে, তা হয়তো একদিন এই শতবর্ষের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলবে। ‘স্বাধীনতা’র নামে এই প্রতারণা আর কতদিন চলবে, সেই প্রশ্ন এখন গোটা মুসলিম বিশ্বের সামনে।
তথ্যসূত্র: Middle East Eye