
আওয়ার টাইমস নিউজ।
নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশজুড়ে চলমান এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের ‘উল্লম্ফন’ এবং জিপিএ ৫ এর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ে তৈরি হয়েছে ব্যাপক আলোচনার ঝড়। শিক্ষা বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন এবং কিছু শিক্ষকের যোগসাজশে গড়ে ওঠা শক্তিশালী এক চক্রের অপতৎপরতার ফলেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
প্রশ্ন ফাঁস, খাতায় লেখা, এবং ভেন্যু বাণিজ্য
দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র—পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের উত্তর বলে দেওয়া, নকল সরবরাহ, এমনকি ভেন্যু কেন্দ্রগুলোতে খাতায় উত্তর লিখে দেওয়ার মতো গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু বেসরকারি কলেজ পরীক্ষায় অস্বাভাবিক ফল করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ভেন্যু কেন্দ্র বাতিল এবং রদবদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই মধ্যে ঢাকা ও যশোর বোর্ড ১০২টি কেন্দ্র বাতিল করেছে, সারাদেশে বাতিল হয়েছে মোট সাড়ে ৪০০ কেন্দ্র, রদবদল হয়েছে আরও ১১০০টির মতো।
ক্যামব্রিয়ান কলেজের ফল বিশ্লেষণে অনিয়মের ইঙ্গিত
ঢাকা বোর্ডের নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ক্যামব্রিয়ান কলেজ ২০১২-২০১৫ সালের মধ্যে দুই বছর শতভাগ এবং দুই বছর ৯৯% এর বেশি পাস করেছে। ২০১৩ সালে সর্বোচ্চ ৯৪১ জন জিপিএ ৫ পায়। ওই সময়গুলোতে পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল ঢাকার আলাতুন্নেছা স্কুল এবং বনানী বিদ্যানিকেতনে। কিন্তু ২০১৭-২০১৯ সালে অন্যান্য কড়াকড়ি কেন্দ্র ব্যবহার করায় পাসের হার নেমে আসে ৯০%-এর নিচে এবং জিপিএ ৫ এর সংখ্যা অনেক কমে যায়।
সেন্ট্রাল কলেজ: কেন্দ্র পরিবর্তনে ফল বিপর্যয়
নরসিংদীর সেন্ট্রাল কলেজেও একই চিত্র। ২০২১-২০২২ সালে যখন পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল ‘নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজে’, তখন পাসের হার ছিল ১০০% এবং ১২৭ জন পর্যন্ত জিপিএ ৫ পায়। কিন্তু কেন্দ্র পরিবর্তন করে ‘পলাশ শিল্পাঞ্চল কলেজ’ নেওয়ার পরই ২০২৩-২০২৪ সালে জিপিএ ৫ এর সংখ্যা নেমে আসে যথাক্রমে ২৩ ও ২১-এ। পাসের হারও কমে ৮৯ দশমিক ৭৫ শতাংশে দাঁড়ায়।
কেন মহিলা কলেজেই ভালো ফল?
গত দশ বছরে মহিলা কলেজে কেন্দ্র থাকাকালে ওইসব প্রতিষ্ঠানে শতভাগ বা কাছাকাছি পাসের হার এবং জিপিএ ৫ হুহু করে বাড়তে দেখা গেছে। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় শিক্ষকদের সমন্বয়ে পরীক্ষার্থীদের খাতায় লিখে দেওয়া হয়েছে। মহিলা কলেজে মাত্র ৩০ জন শিক্ষক থাকলেও পরীক্ষা চলাকালীন বিভিন্ন জায়গা থেকে শিক্ষক আনা হয় এবং তাদের সমন্বয়ে পরীক্ষার পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত হয়।
কেন্দ্র বদলের পেছনে তদবির ও হুমকি
পলাশ শিল্পাঞ্চল কলেজের অধ্যক্ষ জানান, নকলের সুযোগ না থাকায় তিনটি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্র পরিবর্তনের তদবির করে। সেন্ট্রাল কলেজের অধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষরসহ বোর্ডে হুমকি দেন বলেও বোর্ডের একাধিক সূত্র জানায়। যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, এই ধরনের আচরণে শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্বলতা ও অনৈতিকতার নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “নকলের সুযোগ না থাকায় যদি শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে না চায়, এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত। এটা দেখায়, শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, শিক্ষার্থীরাও নকলনির্ভর হয়ে পড়েছে।”
রাজনৈতিক প্রভাব ও আর্থিক লেনদেন
ভেন্যু কেন্দ্র তৈরিতে রাজনৈতিক প্রভাব এবং আর্থিক লেনদেনের চিত্রও উঠে এসেছে। শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ শাখা জানায়, এমন কেন্দ্রে পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁস, নকল সরবরাহ ও পরীক্ষকদের সহযোগিতায় ফলাফল নিশ্চিত করা হতো।
দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ
বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিভিন্ন বোর্ড অনৈতিক সুবিধা দেওয়া এসব ভেন্যু কেন্দ্র বাতিল করছে। অনেক বোর্ড এখনো কাজ করছে। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কেন্দ্র বাতিলের ফলে ফলাফলে সত্যিকারের মেধা প্রতিফলিত হবে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে নৈতিকতা ফিরবে।
আওয়ার টাইমস নিউজ বিশ্লেষণ:
এই চক্র যদি ধ্বংস না করা যায়, তবে পুরো প্রজন্ম নকল, দুর্নীতি আর অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে শিক্ষিত হয়ে উঠবে—যা একটি জাতির জন্য আত্মঘাতী। এই মুহূর্তে কঠোর নজরদারি, কেন্দ্র মনোনয়নে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই জাতীয় স্বার্থে একমাত্র পথ।
#শিক্ষায়_অনিয়ম #পরীক্ষা_কেন্দ্র_বিতর্ক #নকল_রোধ #ভবিষ্যৎ_নির্মাণ #টাইমস_নিউজ