আওয়ার টাইমস নিউজ।
পবিত্র হজের ইতিহাস, লোহিত সাগর সৈকতে মক্কা শরীফের প্রবেশদ্বার হিসেবে জেদ্দা বন্দর বিখ্যাত বহুকাল ধরে। এখানে ভারতবর্ষের বণিকদের চলাচলের ইতিহাসও দীর্ঘ। তারা মসলা, মুক্তা, দামী পাথর, রেশম, চন্দন কাঠ ও সুগন্ধি বোঝাই জাহাজ ভেড়াতেন এ বন্দরে। ইতিহাস থেকে ধারণা করা হয়, ভারতীয়দের হজ করতে জেদ্দায় যাওয়ার ইতিহাস শুরু হয় সিন্ধু বিজয়কালে (৬৬৪ থেকে ৭১২)।
মোগল আমল থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ভারতবর্ষের মুসলিমদের হজে যাওয়ার রাস্তা ছিলো দুটি – স্থলপথে উত্তর-পশ্চিম ভারত অতিক্রম করে পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান-ইরাক হয়ে সউদী আরব। এ পথটা ছিলো খুবই কষ্টের ও বিপৎসংকুল। কেননা, এখানে সাফায়িদ শিয়া জনগোষ্ঠীর দ্বারা হজের কাফেলাগুলো আক্রান্ত হতো হর-হামেশাই! আর তাই, লোহিত সাগর হয়ে সমুদ্র পথে হজ করা ছিলো বেশী জনপ্রিয় এবং তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। তবে এ পথেও বিপদ ছিলো! ষোলো শতকে লোহিত সাগর পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। কার্তাজ নামে ওদের একটি পাস সংগ্রহ করতে হতো হজযাত্রী ও বণিকদের। এটা এক সময় এতোটাই জটিল হয়ে উঠেছিলো যে, মোগল আমলের আলেমগণ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, এ পর্যায়ে হজের বাধ্যবাধকতা নেই!
তবে সুদিনে মোগল শাসকরা হজযাত্রীদের জন্যে সুব্যবস্থা করতেন। তাঁরা কয়েকটি জাহাজ মিলিয়ে একটি নৌবহর তৈরি করতেন। যাত্রীদের যাওয়া ও থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতেন। উছমানীয় খলীফাগণও সিরিয়া ও মিসর থেকে হজযাত্রীদের পথে নিরাপত্তা বিধান করতেন। খলীফাদের বলা হতো পবিত্র ভূমির তত্ত্বাবধায়ক।
গুজরাটের সুরাটকে সেকালে বলা হতো বাব-আল মক্কা বা বন্দরে মোবারক। ভারতবর্ষের হজযাত্রীদের জন্যে এটি ছিলো গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর। সম্রাট আকবরই ছিলেন প্রথম মোগল শাসক – যিনি সরকারী খরচে কিংবা ভর্তুকি দিয়ে হজযাত্রার ব্যবস্থা করতেন। তিনি হাজীদের জন্যে মক্কায় একটি সেবাদানকেন্দ্রও নির্মাণ করেছিলেন। ১৫৭৫ সালে পর্তুগিজদের সাথে নিরাপত্তা চুক্তি হবার পর থেকে আকবর প্রতি বছর একটি হজ নৌবহর পাঠানোর ঘোষণা দেন। তিনি সিনিয়র একজন সভাসদকে মীর হাজী (হজযাত্রীদের নেতা) নিযুক্ত করেন। তাঁর নাম ছিল আব্দুর রহীম খানে খানা। রহীমী, করীমী ও সালারী নামে তাঁর নিজেরই তিনটি জাহাজ ছিলো। তখনকার একজন পরিব্রাজক জন ফ্রেয়ার কিয়ানী ওরফে হাজী মোহাম্মদ আমিন জানাচ্ছেন, জাহাজগুলোর ওজন ছিলো ১৪০০ থেকে ১৬০০ টন এবং যাত্রী পরিবহন করতে পারতো ১,৭০০’র মতো। সম্রাট জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলেও এ ধারা অব্যাহত থাকে। শাহজাহানের আমলেও একজন মীর হাজী নিযুক্ত হয়েছিলেন।
জাহাঙ্গীরের সময় হজযাত্রা নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা ঘটে – যার ফলাফল পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত! ১৬১৩ সালে রহীমী জাহাজটি (যার মালিক ছিলেন মরিয়ম-উজ-জামানী ওরফে যোধা বাই – জাহাঙ্গীরের মা) কার্তাজ নেয়া সত্ত্বেও পর্তুগিজদের দ্বারা আক্রান্ত হয়! ইউরোপের লোকজনও জানতো যে, রহীমী তীর্থযাত্রায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ! জাহাজটি আক্রান্ত হওয়ায় মোগল সম্রাট খুব অসম্মান বোধ করেন। ‘শত্রুর শত্রু মিত্র’ এ তত্ত্ব মোতাবেক, জাহাঙ্গীর বৃটিশদের প্রতি নরম হন এবং বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে ভারতবর্ষে ব্যবসা করার অনুমতি দেন!
সম্রাট আওরঙ্গজেবের (কুদ্দিসা সিররুহুল আজীজ) আমলে প্রতি বছর রাজকীয় দুটি জাহাজ লোহিত সাগর পাড়ি দিতো। ট্যাভার্নিয়ার দেখেছেন – এসব জাহাজে যাত্রীদের কোনো খরচ বইতে হতো না। মোগল হারেমের রমণীরা এসব জাহাজের যাত্রী হতেন। আওরঙ্গজেবের মেয়ে জেবুন্নেসাও হজযাত্রীদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। সফী বিন ওয়ালী আল-কাজভিনী নামের একজন পণ্ডিতকে তিনি হজ করিয়ে এনেছিলেন কুরআন শরীফের তাফসীর করার পুরস্কার হিসেবে। জানা যায়, সফী সাব ’সালামাত রাস’ নামের জাহাজে করে রওনা দিয়েছিলেন ১৫ই শাওয়াল ১০৮৭ (১৬৭৬ খৃঃ)। কাজভিনী তাঁর যাত্রাপথের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে একটি বই লিখেছিলেন – যার নাম আনিসুল হজ। বইটি মুম্বাইয়ের প্রিন্স অব ওয়েলস জাদুঘরে রয়েছে। মোগল শাসকরা ষড়যন্ত্রকারীকেও হজে পাঠাতেন। এমনকি কাউকে নির্বাসন দিতে চাইলেও হজে পাঠিয়ে দিতেন। আকবর যেমন বৈরাম খানকে পাঠিয়েছিলেন। কেননা, বৈরাম খানের মাতব্বরী তাঁর কাছে তখন অসহ্য ঠেকছিলো। সেটি ১৫৫৩ সাল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বৈরাম খান সুরাট যাওয়ার পথে আহমেদাবাদে একজন আফগান কর্তৃক নিহত হন! জাহাঙ্গীর ভুল চিকিৎসার জন্যে সাজা হিসেবে তাঁর পারশিক হেকিম সাদরাকে মক্কা শরীফে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবও তাঁর একজন কাজীকে বিরক্ত হয়ে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন এবং হজে পাঠিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৫৭৬ থেকে ১৫৮২ সাল – প্রতি বছর সম্রাট আকবরের মীর হাজী ছ’ লাখ রুপি পবিত্র মক্কা ও মদীনায় খরচ করতেন; সেই সাথে খিলাতও (আলখাল্লা) বিতরণ করতেন। আর মক্কার শরীফের জন্যে মূল্যবান উপহার নিয়ে যেতেন। ১৬৫৯ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব শেরিফের জন্যে সাড়ে ছ’ লাখ রুপি মূল্যমানের উপহার পাঠিয়েছিলেন।
তবে উছমানীয় ও মোগল শাসকগণ হাজার হাজার লোককে হজ করতে পাঠালেও নিজেরা কখনো হজে যেতে পারেননি! কেননা, তাঁদের হজ করতে যাওয়া মানে – দীর্ঘ সময় ধরে সালতানাত ও সাম্রাজ্য কিংবা রাজধানী থেকে অনেক দূরে অবস্থান করা। আর এ সময়ে অভ্যুত্থান বা শত্রুর আক্রমণের হুমকির আশংকা থাকতো। ফলে, ৩৬ জন উছমানীয় খলীফা ও ১৯ জন মোগল বাদশার কারোরই হজ নসীব হয়নি! এমনকি পরবর্তীকালে গুজরাট, বিজাপুর, বেঙ্গল বা হায়দরাবাদের নিজামরাও একই কারণে হজ করতে পারেননি। তবে খুব সম্ভ্রান্ত মহিলাদের মাঝে আকবরের ফুপু – মানে, সম্রাট বাবরের মেয়ে গুলবদনের নাম পাওয়া যায়। তিনি হজ করেছিলেন ১৫৭৬ সালে। আর সম্রাজ্ঞী হিসেবে প্রথমা হাজী খেতাব পেয়েছেন ভূপালের সিকান্দার বেগম ১৮৬৩ সালে। তিনি ১৫০০ সঙ্গী-সাথী নিয়ে পুরো একটি জাহাজ রিজার্ভ করেন। তাঁর সঙ্গীদের অন্যতম ছিলেন তাঁর মা কুদসিয়া বেগম। বলা হয়, তিনি পুরো পথ পয়সা বিলিয়েছেন! মক্কা শরীফে পৌঁছার পর তাঁদের জন্যে শেরিফের (প্রশাসক) তরফ থেকে ৫০ রকমের রাজকীয় খাবার পাঠানো হয়েছিলো! ১৮৮৫ সালে বৃটিশ সরকারের নির্ধারিত হজ এজেন্সি ছিলো টমাস কুক অ্যান্ড সন্স। টমাস কুক এজেন্সি রেলপথ, নৌপথ, পাসপোর্ট, টিকেটিং, চিকিৎসা ইত্যাদি সব কিছুর দায়িত্ব পেয়েছিল। ১৯২৭ সালে বোম্বের পুলিশ কমিশনার ডি. হিলির নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি হজ কমিটি গঠিত হয়েছিলো। ১৯৫৯ পর্যন্ত এ রকম কমিটি কার্যকর ছিলো। ১৯৫৯ সালে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ১০ রুপি ও ১০০ রুপির বিশেষ হজ নোট চালু করে। এগুলোর নম্বর শুরু হতো এইচএ দিয়ে। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানও হজ নোটের প্রচলন ঘটিয়েছিল। এক হিসাবে দেখা যায়, মগুল লাইন শিপস ১৯২৭ সালে ২০ হাজার হজযাত্রী মক্কায় নিয়ে গেছে।
যাহোক, আজ থেকে তিন–চার দশক আগেও বাঙালী মুসলমানের জন্যে হজ করাটা দুঃসাধ্য ছিলো। মহান এ সফরের ভাগ্য অনেকেরই হতো না; যদিও মুসলমান মাত্রই স্বপ্ন দেখতেন যে, তাঁরা একদিন জাহাজে চেপে সাগর পাড়ি দেবেন পবিত্র হেজাজের পথে। রাসুলে পাকের (সল্লাল্লাহুতা’লা ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্র স্মৃতি খুঁজে ফিরবেন মক্কা-মদীনা শরীফাঈনের অলিতে-গলিতে। কাবা শরীফের কালো গিলাফ আর হাজরে আসওয়াদের স্পর্শে পবিত্র করবেন নিজেদেরকে; প্রাণের চেয়ে প্রিয় নবীজীর রওজা মোবারকে পেশ করবেন সাধ্য মতো দরূদ ও সালাম। একদা কাজী নজরুল ইসলাম হয়তো বাঙালীর সেই অভিব্যক্তিই পেশ করেছিলেন নিজের কবিতা ও গানে – মদীনায় যাবি কে কে আয় আয়/উড়িল নিশান, দ্বীনের বিষাণ বাজিল যাহার দরওয়াজায়।
তবে সেকালে এ স্বপ্ন পূরণ হতো হাতে গোণা কিছু মানুষের – যাঁদের অর্থবিত্ত, তাকত, দৃঢ় মনোবল ও মজবুত ঈমান ছিলো, কেবল তাঁরাই পৌঁছাতে পারতেন কাঙ্ক্ষিত সেই মঞ্জিলে। তাই, তাঁরা হতেন সংখ্যায় নগণ্য। সমাজে ভাগ্যবান ও দ্বীনদার এসব হাজীর কদর ছিলো খুবই। কোনো বংশে একজন হাজী থাকা মানে – সেই বংশের শান-শওকত কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়া। এমনও হয়েছে – গ্রামের কেউ হজ করায়, সেই গ্রামের পুরোনো নাম পাল্টে হাজীপুর, হাজীগঞ্জ, হাজীপাড়া, হাজীবাগ ইত্যাদি হয়ে গেছে!
গত শতকের আশির দশক পর্যন্ত হজের পুরো প্রক্রিয়াটি ছিলো খুবই জটিল, দীর্ঘ আর কষ্টসাধ্য। হজের প্রস্তুতি নিতেই চলে যেতো বছরের পর বছর! হজযাত্রীগণ নিজেদেরকে বৈষয়িক সব ধরণের বিষয়–আশয় থেকে মুক্ত করে তবেই সফর করতে চাইতেন হজের উদ্দেশ্যে। ছেলেমেয়ের বিয়েশাদী, সহায়-সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা ও আর্থিক লেনদেনের পাট চুকিয়ে তারপরেই না বাইতুল্লাহ শরীফের মুসাফির। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবাই বয়স করেই হজে যেতেন। যুবারা তেমন কেউ যেতেন না। এর অবশ্য কিছু কারণও ছিলো। অনেকেই ভয়ে থাকতেন যে, আর ফিরে আসতে পারবেন কিনা। বিপৎসংকুল দীর্ঘ সফরে রোগ-শোকে অনেকেই পথে মারা যেতেন; কেউ কেউ হারিয়েও যেতেন! ফলে, ভাবতেন – যাবো যেহেতু, একেবারেই যাই। কেউ কেউ মক্কা বা মদীনা শরীফে মারা যাওয়ার প্রত্যাশাও করতেন। কারো আবার ফিকির ছিলো – হজ করে এসে সব দুনিয়াদারী ছেড়ে দেবেন। সুতরাং শেষ বয়সে গেলেই ভালো। এ নিয়ে কবি আল মাহমুদ তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন – আমাদের অঞ্চলের লোকজনই বয়স হলে হজে যায়। অথচ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার ছেলেমেয়েরা বিয়ের সাথে সাথেই হজ করতে যায়। কী যে দারুণ লাগে দেখতে!
তখন হাজী সাবদের বাড়ী থেকে বিদায় দেয়া হতো বেশ ঘটা করে। আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশী – সবাই ভেজা চোখে ঘাট বা স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতেন এবং সবাই তাঁদের নিজ নিজ নাম উচ্চারণ করে নবীজীকে (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) সালাম দিতেন। হাজী সাবের ওপর দায়িত্ব থাকতো – তিনি যেনো মদীনা শরীফে গিয়ে নবীজীর রওজা শরীফে সালামটুকু পৌঁছে দেন।
উপমহাদেশ বা বাঙালী মুসলমান হজযাত্রীগণ আনাচ-কানাচ থেকে দল বেঁধে পায়ে হেঁটে, গরু-মহিষের গাড়ীতে চেপে বা দাঁড়টানা নৌকায় করে তখনকার বোম্বে বা করাচী বন্দরে এসে পৌঁছতেন। বিরূপ আবহাওয়ায় যাত্রাপথে অনেকেরই জীবনের সমাপ্তি ঘটতো! কেউ অসুস্থ হয়ে পড়তেন; কেউবা জাহাজ মিস করতেন। ফলে, সেখানেই (বোম্বে বা করাচী) তাঁরা রয়ে যেতেন বাকী হাজীগণ ফিরে আসা পর্যন্ত। আর তাঁরা ফিরে এলে, তাঁদের সাথে ঘরে ফিরতেন হজ করতে না পারা হজযাত্রীগণ। এঁদেরকে বলা হতো বোম্বাই বা পাকিস্তানী হাজী।
হজযাত্রার উদ্দেশে তখন বোম্বে থেকে জাহাজ প্রথমে রওনা হতো পাকিস্তানের করাচীতে। সেখান থেকে জাহাজে উঠতেন আরো হজযাত্রী। এরপর আরব সাগর পাড়ি দিয়ে আরব উপদ্বীপের এডেন বন্দরে ভিড়তো জাহাজ। পথে ঝড়ঝঞ্ঝার দুর্ভোগ তো ছিলোই!
বাঙালী হাজীদের মাঝে খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ (’আলাইহির রহমাহ) হজে গিয়েছিলেন ১৯১২ সালে। হজ থেকে ফিরে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখে গেছেন ’আমার জীবন ধারা’ নামক বইয়ের ‘আমার হজ’ অধ্যায়ে। এখানে পাওয়া যায় ভয়ংকর সমুদ্রযাত্রার বিবরণ: আমি করাচী বন্দরে গিয়ে জাহাজে উঠি। জাহাজের প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণী ছাড়া আর কোনো শ্রেণী ছিলো না। প্রথম শ্রেণীর টিকিটের দাম ৪৫০ টাকা। প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের জাহাজের দোতলায় থাকার জায়গা দেয়া হলো। আমাদের সাথে প্রচুর চাল, ডাল, ঘি, চিনি ও চা ছিলো। আমাকে রান্নার ভার দেয়া হলো। আমি দুপুরে খিচুড়ি রাঁধতাম। রাতে আমার একজন সহযাত্রী ইন্সপেক্টর সাহেব রুটি তৈরি করতেন। মঞ্জিলে মঞ্জিলে কেবল জ্বালানী কাঠ ও পানি খরিদ করা হতো। পথিমধ্যে মাছ দুষ্প্রাপ্য ছিলো। তবে ছাগলের মাংস পাওয়া যেতো। জাহাজ সোকোট্টার (ভারত মহাসাগরে চারটি দ্বীপের একটি মালা, ইয়েমেনের অংশ) কাছে পৌঁছালে সমুদ্রে গর্জন শুরু হয়। উত্তাল তরঙ্গে জাহাজ দুলে ওঠে! আমাদের কামরার কাচের সব বাসনপত্র ভেঙে চুরমার হয়ে যায়! অন্ধকারের ভেতর আমি হাঁটু গেড়ে জাহাজের শিকল ধরে মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকি। ডেকের যাত্রীরা বমি ও মলমূত্র ত্যাগ করে দেয়।
অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ূম তাঁর ‘সমুদ্রপথে হজ গমন অভিজ্ঞতা’ নামের একটি লেখায় হজ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন – তবে মাঝেমধ্যে আবার এ সমুদ্রযাত্রা সুখকর হয়ে উঠতো আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে। জাহাজ সাধারণত উপকূল থেকে কিছুটা দূর দিয়ে যায়। রাতে উপকূলে অনেক বিজলি বাতি নজরে পড়লে বোঝা যেতো যে, কোন নগরী অতিক্রম করা হচ্ছে। বিভিন্ন শহর-নগর অতিক্রমকালে মাইকে তা জানিয়ে দেয়া হতো। বঙ্গোপসাগরে সূর্যাস্তের সময় হাজার হাজার হাঙর দেখা যেতো! বিরাট আকারের তিমি ভেসে উঠতো জাহাজের কাছে এসে! উড়ুক্কু মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে কখনো পড়তো জাহাজের পাটাতনে! সে ছিলো অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা!
হজ শেষে বাড়ী ফিরে এসব গল্প করতে করতেই মাস ছয়েক কাটিয়ে দিতেন হাজী সাবরা। কতোসব গল্প যে থাকতো তাঁদের ঝুড়িতে!
এডেনে যাত্রাবিরতির পর, ইয়েমেনের উপকূলীয় দ্বীপ কামারানে কোয়ারেন্টাইনের জন্যে নামিয়ে দেয়া হতো হাজীদের। কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে থাকার সময়সীমা হাজীদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে কখনো এক সপ্তাহ, কখনো এক মাস করা হতো। কোয়ারেন্টাইন শেষে জাহাজ গিয়ে ভিড়তো জেদ্দায়। পথে ইয়ালামলাম নামক স্থানে ইহরাম বাঁধতে হতো। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের মিকাত (হজের নিয়ত ও ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত এলাকা)।
জেদ্দায় নেমে হাতে সময় থাকলে কাফেলা রওনা হতো মদীনা শরীফ অভিমুখে। নইলে, তাঁরা রওনা হতেন পবিত্র কাবার পথে – মক্কা শরীফে। সেকালে সবচেয়ে কষ্টকর ছিলো মরুর এ যাত্রাপথ। একে তো সূর্যের প্রখর তাপ; অন্যদিকে বেদুইন দস্যুদের অত্যাচার! সুযোগ পেলেই অতর্কিত হামলা চালাতো ওরা!
খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ সাব জানাচ্ছেন – জাহাজ জেদ্দা বন্দরে পৌঁছালো। এরপর আমরা উটের পিঠে উঠে মদীনা শরীফ অভিমুখে যাত্রা শুরু করি। মদীনা শরীফ এখান থেকে ২৫০ মাইল দূরে। পথে অনেক মঞ্জিল রয়েছে। প্রত্যেক মঞ্জিলে জ্বালানী কাঠ ও মশকভরা পানি পাওয়া যায়। পাওয়া যায় কফি, খেজুর আর তরমুজ। বাদ-জোহর কাফেলা চলতো। শেষরাতে এসে মঞ্জিলে পৌঁছাতো। আমাদের কাফেলায় ৩০০টি উট ছিলো। শত্রুভয়ে কাফেলা পথে থামতো না! মঞ্জিলে পৌঁছানোর পর গোসল, পায়খানা-প্রস্রাব ও খাওয়া-দাওয়া সম্পন্ন হতো। আমরা কয়েকটি মঞ্জিলে খুব কষ্টে পৌঁছলাম। রাত নামলেই শত্রুরা বন্দুক ও তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে আসতো! তাদের টাকা দিয়ে খুশী করতে হতো! এদের উৎকোচ দিতে গিয়ে আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়লাম। আমরা তাদের সাথে লড়াই করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম। একজন হারামী (শত্রু) এসে তলোয়ার দিয়ে আমাদের কাফেলা-যাত্রীর আঙুল কেটে দেয়!
তখন কেবল যে দস্যু বা বেদুইনদের হামলা ছিলো, তা নয়; ছিলো পানি ও খাবারের সংকট। প্রায়ই কাফেলার খাবার শেষ হয়ে যেতো। তখন কাফেলার লোকজন আরব লোকদের বাড়ী গিয়ে উঠতো। আরবরা অবশ্য মেহমানদারীতে কখনো কার্পণ্য দেখাতেন না – সেকালের বিভিন্ন হাজীর স্মৃতিকথায় এমনই উল্লেখ আছে।
মক্কায় পৌঁছার পর সুবিধামতো জায়গায় তাঁবু গেড়ে হজের হুকুম-আহকাম পালন করতেন হাজীগণ; যেমন- কাবা শরীফ তাওয়াফ করা, জামারায় শয়তানকে লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া, সাফা-মারওয়া সায়ী করা ইত্যাদি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে প্রকাশিত ১৯৫৩ সালের একটি ছবিতে দেখা যায় – হাজীগণ বাজার থেকে দরদাম করে কুরবানীর জন্যে দুম্বা কিনছেন। আরেক ছবিতে দেখা যায়, মিনার ময়দানে খোলা আকাশের নিচে তাঁরা খাবার পাকাচ্ছেন – যা বর্তমানে প্রায় অসম্ভব।
হজের সময় মক্কা শহরে আলাদা একটি উৎসবের আমেজ দেখা দেয়। সেকালেও দিতো। আরবরাও বেশ আনন্দে থাকতো তখন। বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর সফরনামায় উল্লেখ করেন যে, তিনি ১৩২৫ সালে হজ করেন। তাঁর বর্ণনায় ভিন্ন রকম এক মক্কার দেখা পাওয়া যায়: হজের সময়ে হাজারো হাজীর ভিড়ে রীতিমতো গমগম করে পুরো নগর। তখন অকাতরে দান-খয়রাত করেন হাজীগণ। দানের সময় কোনো গরীব-মিসকীনকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলে, তার মুখে সোনার মোহর গুঁজে দিচ্ছেন হাজীরা – এমন দৃশ্যও দেখেছেন ইবনে বতুতা!
হজের যাবতীয় কাজ শেষ করে কাফেলা সফর করতো পবিত্র মদীনা পানে। আবারো মাইলের পর মাইল মরুযাত্রা। যেখানেই পানি আর ছায়ার সন্ধান পাওয়া যেতো, সেখানেই যাত্রাবিরতি করতো কাফেলা। খানিক বিশ্রামের পর আবার পথচলা শুরু – সকাল আর বিকেলেই কেবল উট চলতো। দুপুরে নেয়া হতো বিশ্রাম। এভাবে মদীনা শরীফে পৌঁছে নবীজীর (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) রওজা শরীফে লুটিয়ে পড়তেন সবাই! রওজা শরীফ দর্শনে কেউ কেউ আত্মহারা হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন! মদীনা শরীফ জিয়ারত শেষে শুরু হতো ঘরে ফেরার পালা। তখন কাফেলার জনসংখ্যা আর আগের মতো থাকতো না। অনেকেই মারা যেতেন!
ছ’-সাত মাস পরে পবিত্র আবে জমজমের পানি আর মদীনা শরীফের খেজুর নিয়ে কোনো এক সন্ধ্যায় হজ থেকে ফেরা হাজীগণ হাজির হতেন পরিবার–পরিজনের কাছে। নতুন হাজী ফিরেছেন শুনলেই পাড়া-প্রতিবেশী জড়ো হতেন তাঁকে দেখতে। চাঁদের আলোয় উঠানে পাটি বিছিয়ে তাঁর কাছ থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন পবিত্র মক্কা–মদীনার গল্প। আর এভাবেই সেকালে গ্রামে-গ্রামে, মহল্লায়-মহল্লায় মানুষের মুখে মুখে রচিত হতো হজের অপূর্ব ভ্রমাণাখ্যান। সূত্র: কালের কণ্ঠ, রাইজিং বিডি ও প্রথম আলো। সম্পাদনা: সাইফুল ইসলাম রুবাইয়াৎ।