আওয়ার টাইমস নিউজ।
শেখ হাসিনার প্রথমবারের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলেই (১৯৯৬-২০০১) সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সারা বিশ্বে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশে ক্রমেই ইসলামি জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটছে। এ ধরনের আত্মবিধ্বংসী প্রচারণার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও তথাকথিত চেতনাপন্থি বাম ও সুশীল গোষ্ঠী প্রধানত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমর্থন ও রাজনৈতিক ফায়দা লাভের চেষ্টা করেছিল। সেসময় দেশে বেশ কিছু ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলা ঘটানো হলে জঙ্গিবাদের প্রচারণা বিশ্বাসযোগ্যতাও পেতে শুরু করে। এসব হামলার মধ্যে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল (পয়লা বৈশাখ) রমনার বটমূলে ছায়ানটের বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলা হলে বিশ্বের দৃষ্টি উঠতি ‘ইসলামি জঙ্গিবাদী’ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের দিকে নিবদ্ধ হয়। ওই হামলায় কথিত হামলাকারী হরকাতুল জেহাদ সদস্য সুজনসহ ১০ জন নিহত হয়েছিল। ২০১৪ সালে নিম্ন আদালতের রায়ে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে মুফতি হান্নানের দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। রমনার আগে যশোরে ১৯৯৯ সালের ৬ এপ্রিল উদীচীর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অনুরূপ বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছিল। সেই ঘটনায়ও হরকাতুল জেহাদকেই দায়ী করা হয়ে থাকে।
ইসলামি জঙ্গিবাদের প্রচারণার এমন এক সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন বাংলাদেশে কয়েক ঘণ্টার অতি সংক্ষিপ্ত সফর করেন। এটাই ছিল বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফর। সেই সফরের প্রাক্কালে কূটনৈতিক মহলকে বিস্মিত করে বাংলাদেশ সরকার দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের ওপর এক পুস্তিকা প্রকাশ করে। সচরাচর কোনো দেশই সরকারিভাবে জঙ্গিবাদের উপস্থিতি মেনে নেয় না। এতে সেই দেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অবশ্য আওয়ামী লীগ কোনোদিনই বাংলাদেশের স্বার্থ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। দলটির একমাত্র লক্ষ্য ছিল যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকা। সেই বিতর্কিত পুস্তিকা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা এই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে, বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তার ক্ষমতায় টিকে থাকা অপরিহার্য। উল্লেখ করা দরকার, তখনও নিউ ইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলায় টুইন টাওয়ার বিধ্বস্ত হয়নি। কাজেই ইসলামোফোবিয়াও এখনকার মতো পশ্চিমা দুনিয়ায় এতখানি বিস্তার লাভ করেনি। ফলে আওয়ামী সরকারের প্রপাগান্ডা যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, সেটা অর্জিত না হয়ে বরঞ্চ উল্টো ফল হয়। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন সাভার স্মৃতিসৌধে তার পূর্বনির্ধারিত সফর বাতিল করে দেন। তখন বাধ্য হয়ে শেখ হাসিনাকে সব প্রটোকল বিসর্জন দিয়ে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও মূল্যবান অতিথির সঙ্গে দেখা করতে হয়েছিল।
এরপর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করলে দিল্লির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বাংলাদেশ সরকারকে দুর্বল ও হেয় করার জন্য ভারত সরকার এবং সে দেশের সাম্প্রদায়িক মিডিয়া মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ইসলামি জঙ্গিবাদের প্রচারণাকে গ্রহণ করে। ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি দ্রুত আফগানিস্তানের মতো হয়ে যাচ্ছে’—এ ধরনের বয়ান ভারত থেকে জন্মলাভ করে পশ্চিমা দেশগুলোয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবরের (Syndicated News) মাধ্যমে বিস্তার লাভ করতে থাকে। ২০০২ সালের ৪ এপ্রিল ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ পত্রিকায় বার্টিল লিন্টনার নামে এক সাংবাদিক ‘A Cocoon of Terror’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার আগুনে ঘি ঢালার কর্মটি সম্পাদন করেন। তত দিনে মার্কিন মুলুকে এক-এগারোর সন্ত্রাসী হামলা ঘটে গেছে। বিশ্বব্যাপী সেই চরম ইসলামবিদ্বেষী পটভূমিতে বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সর্বৈব মিথ্যা প্রচারণাটি আজকের প্রজন্মের ভাষায় রীতিমতো ভাইরাল হয়ে পড়ে। সুযোগ বুঝে বাংলাদেশের সুশীল ও আওয়ামী সমর্থক মিডিয়া সরাসরি দেশের স্বার্থবিরোধী প্রচারে সোৎসাহে অংশগ্রহণ করে। এই শ্রেণির মিডিয়ার ইসলামবিদ্বেষী চরিত্রের কোনোকালেই পরিবর্তন ঘটেনি। উদাহরণস্বরূপ, ডেইলি স্টার পত্রিকায় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি পোস্টের কথা উল্লেখ করছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আবদুল মান্নানের লেখা পোস্টটির শিরোনাম: ‘Don’t let Bangladesh become a cocoon of terror.’ আপাদমস্তক আওয়ামী লীগার, ইন্ডিয়াপন্থি বাম ঘরানার আবদুল মান্নানের লেখাটির ছত্রে ছত্রে চরম ইসলামবিদ্বেষ, বিশেষ করে মাদ্রাসা ও ইসলামি শিক্ষাবিরোধী কট্টর মনোভাব ফুটে উঠেছে। এই শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াই বাংলাদেশে কথিত ইসলামি জঙ্গিবাদ উত্থানের বয়ান দিল্লির স্বার্থ রক্ষায় সর্বদা ফেরি করেছে।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ভারত ও ডিজিএফআই’র মদতে আবার ক্ষমতা লাভ করলে বাংলাদেশ ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণার জন্য এক উৎকৃষ্ট স্থানে পরিণত হয়। কল্যাণপুরের জাহাজবাড়িতে জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করে গুম হয়ে যাওয়া ৯ জন নিরাপরাধ তরুণকে ডিবি থেকে এনে এক বন্ধ ঘরে আটকে রেখে নির্মমভাবে হত্যা করে আওয়ামী পুলিশ। ঘটানো হয় হোলি আর্টিজান ম্যাসাকার, যেখানে এক রাতে ২০ জন দেশি ও বিদেশি জিম্মি, পাঁচজন কথিত ইসলামি জঙ্গি এবং দুজন পুলিশ নিহত হয়। এই রহস্যাবৃত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের নামে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করে এবং ক্রসফায়ার দেয় আরও আট তরুণকে। হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যা করা তরুণটির চেহারা এতটাই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, তার মা পর্যন্ত তাকে চিনতে পারেননি। ছেলের ওই অবস্থা দেখে তিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলেছিলেন, ওই তরুণের লাশ তার ছেলের হতে পারে না।
উপরোক্ত দুই বহুল আলোচিত কথিত জঙ্গি অপারেশন ছাড়াও ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনামলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডজন ডজন জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। সেই নাটকগুলোর একাধিক স্ক্রিপ্টে বাবা, মা, সন্তানসহ পুরো পরিবারকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিতেও কিছুমাত্র বিচলিত হয়নি পিশাচ হাসিনার পোষ্য খুনি পুলিশ। এ রকম এক মর্মান্তিক ঘটনায় কয়েক মাসের শিশুর ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহাংশের বর্ণনা পড়ে নীরবে চোখের পানি মুছেছি, কিন্তু কোনো মিডিয়া সত্য অনুসন্ধানের ন্যূনতম চেষ্টাও করেনি। পুলিশ ও র্যাবের প্রেসনোটের ভাষ্য কোনোরকম যাচাই-বাছাই ব্যতিরেকে পত্রিকার লিড নিউজ হয়েছে। ২২ ডিসেম্বর আমার দেশের পুনঃপ্রকাশের পর আজ মাত্র ১৮ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমরা সেসব মর্মান্তিক ঘটনার অজানা ইতিহাস পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি।
তবে আজ লিখতে বসে আমার মনে ভিন্ন এক প্রশ্ন জেগেছে। হোলি আর্টিজানের কথাই বিবেচনা করুন। সেই ভয়াল রাতে ১৪ দেশি-বিদেশি জিম্মিকে যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই। এই পৈশাচিক কাজ কারা করল, কেন করল, সেটা অবশ্যই প্রমাণসহ জানা দরকার। এমনটাও কি হতে পারে যে, বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণের জন্য কোনো বিদেশি শক্তি তার ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করতে হয়—(১) ভাড়া করা পেশাদার খুনি, অথবা (২) সেদেশের কিংবা বাংলাদেশের এজেন্সি, কিংবা (৩) বাংলাদেশে অথবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের বিপথগামী জঙ্গি তরুণদের ব্যবহার করে হোলি আর্টিজান ম্যাসাকার ঘটিয়েছে? শেখ হাসিনার সরকার হয়তো পুরো ষড়যন্ত্রটির বিষয়ে আগে থেকেই জানত; নইলে ঘটনাস্থল থেকে কোনো আসামিকে আটক করে জীবিত অবস্থায় তাকে বিচারের জন্য আদালতে কেন পেশ করা হলো না? রাতের ম্যাসাকারে অংশ নেওয়া খুনিদের সবাইকেই হয় হত্যা করা হয়েছে, অথবা পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’-এর কার্যপদ্ধতি (Modus Operandi) এরকমই হয়ে থাকে।
ad
পাঠকদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, বিভিন্ন দেশে ‘র’-এর আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে ভারতের সঙ্গে তাদের একদা অতি ঘনিষ্ঠ পশ্চিমা মিত্র কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। কানাডার নাগরিক ও বিদ্রোহী শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে কানাডার এক শিখ গুরুদোয়ারার সামনে আততায়ীরা ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে পালিয়ে গেছে। কানাডার পুলিশ তদন্ত করে সেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ‘র’-এর জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ পেয়েছে। এমনকি ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান অজিত ডোভালের নামও গুপ্তহত্যা প্রসঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রেও দিল্লির একই ধরনের গুপ্তহত্যার (Targeted Killing) পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে ‘র’ বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখ নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুন হত্যার জন্য নিখিল গুপ্ত নামে এক ব্যক্তিকে ভাড়া করেছিল। কিন্তু পান্নুন খুনের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা আগাম জেনে গেলে ‘র’-এর পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট নিখিল গুপ্ত এবং ‘র’-এর এজেন্ট বিকাশ যাদবের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেছে।
ভারতীয় ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার কাজের ধরন বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের কথিত জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা সন্দেহ করার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের কোনো সরকার অদ্যাবধি এ বিষয়ে ঐকান্তিক কোনো তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে বলে আমার জানা নেই। হয়তো তারা ভারতকে অসন্তুষ্ট করার ঝুঁকি নিতে চায়নি। আমরা আশা করি, ইউনূস সরকার এ-জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে অনতিবিলম্বে বিশদ তদন্ত শুরু করবে। নাহলে আবারও এদেশে হোলি আর্টিজানের মতো ম্যাসাকার ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। জুলাই বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার দিল্লিতে পলায়নের পর থেকে ভারত সরকার বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য একের পর এক অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। ইসলামপন্থিদেরও এসব বিদেশি ফাঁদ সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। অতি ইসলামিস্ট হয়ে কোনোরকম চরমপন্থার দিকে ধাবিত হলে ইসলাম ও বাংলাদেশের শত্রুরাই লাভবান হবে। আলেমের ছদ্মবেশে আওয়ামী দালালরাও বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে হঠকারী কর্মসূচি গ্রহণের জন্য উসকানি দিতে পারে। তাদের সম্পর্কেও বাংলাদেশের প্রকৃত ইসলামপন্থিদের সতর্ক থাকতে হবে।
সবশেষে পাঠকদের আশ্বস্ত করতে চাই, অতি সীমিত সামর্থ্য নিয়েই আমার দেশ নিজস্ব অনুসন্ধান চালিয়ে যাবে। আমরা নির্ভয়ে সর্বদা সত্যটা জানিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মহান আল্লাহ তায়ালা, বাংলাদেশ ও পাঠক ছাড়া কারও কাছে আমাদের দায়বদ্ধতা নেই।
সূত্র: আমার দেশ পত্রিকা