আওয়ার টাইমস নিউজ।
ইসলামী ডেস্ক: শবে বরাত (لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَان) অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্যরাত ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত, যা রহমত, মাগফিরাত (ক্ষমা) ও মুক্তির জন্য বিশেষ ফজিলতপূর্ণ। এই রাতকে নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত থাকলেও, কোরআন ও সহিহ হাদিসে এটি মূলত তওবা, ইবাদত ও আল্লাহর ক্ষমা লাভের রাত হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।
শবে বরাত সম্পর্কে কোরআনের আলোকে বিশ্লেষণ:
কোরআনে সরাসরি "শবে বরাত" শব্দটি উল্লেখ নেই, তবে কিছু তাফসিরকারক সুরা আদ-দুখানের নিম্নলিখিত আয়াতকে এ রাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন—
সুরা আদ-দুখান, আয়াত ৩-৪
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ ۚ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ (٣) فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ (٤)
অর্থ:
“নিশ্চয়ই আমি এক বরকতময় রাতে এই কিতাব (কোরআন) নাজিল করেছি। নিশ্চয়ই আমরা সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থির করা হয়।”
(সুরা আদ-দুখান: ৩-৪)
তাফসির বিশ্লেষণ: অধিকাংশ তাফসিরবিদের মতে, এখানে "বরকতময় রাত" বলতে লাইলাতুল কদর বোঝানো হয়েছে, শবে বরাত নয়। কারণ কোরআন রমজানের লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ হয়েছে, যা স্পষ্টভাবে সুরা আল-কদর (৯৭:১)-এ উল্লেখ আছে।
শবে বরাত সম্পর্কে প্রমাণিত সহিহ হাদিস:
শবে বরাতের রাত সম্পর্কে কিছু সহিহ ও হাসান (বিশ্বাসযোগ্য) হাদিস পাওয়া যায়, যেখানে এই রাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা।
১. আল্লাহ এ রাতে বান্দাদের ক্ষমা করেন
عَنْ أَبِي مُوسَى ٱلْأَشْعَرِيِّ، عَنِ ٱلنَّبِيِّ ﷺ قَالَ: إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ، إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ
অর্থ:
"আবু মুসা আশ'আরী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন: আল্লাহ শাবান মাসের মধ্যরাতে (শবে বরাতে) তাঁর সৃষ্টিজগতের প্রতি দৃষ্টি দেন এবং সকলকে ক্ষমা করে দেন, তবে মুশরিক (যে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে) ও বিদ্বেষপোষণকারী ব্যক্তি ছাড়া। (ইবনে মাজাহ: ১৩৯০, সহিহ হাদিস)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, শবে বরাতের মূল গুরুত্ব হলো
*আল্লাহর ক্ষমা লাভ করা
*শিরক ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হওয়া
*তওবা ও ইবাদতের মাধ্যমে নৈকট্য অর্জন
২. এ রাতে আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ: قَالَ النَّبِيُّ ﷺ: يَنْزِلُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَىٰ إِلَىٰ سَمَاءِ ٱلدُّنْيَا لَيْلَةَ ٱلنِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، فَيَغْفِرُ لِأَكْثَرَ مِنْ عَدَدِ شَعْرِ غَنَمِ بَنِي كَلْبٍ
অর্থ:
"আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন: শবে বরাতের রাতে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বনু কালব গোত্রের ভেড়ার পশমের সংখ্যা থেকেও অধিক সংখ্যক মানুষকে ক্ষমা করে দেন।"
(তিরমিজি: ৭৩৯, হাসান হাদিস)
এই হাদিস থেকে স্পষ্ট হয় যে, এ রাতে আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার দরজা উন্মুক্ত থাকে।
শবে বরাতে করণীয় আমল (ইবাদত ও দোয়া)
১.নফল নামাজ: এই রাতে একাকী নফল নামাজ পড়া উত্তম। তবে নির্দিষ্ট কোনো রাকাত নেই।
২.কোরআন তিলাওয়াত: কোরআন অধ্যয়ন করা উত্তম ইবাদত।
৩.তওবা ও ইস্তেগফার: আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা জরুরি।
৪.জিকির ও দোয়া: দোয়া করা এবং আল্লাহর স্মরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫.সদকা ও দান: দান-সদকা করা আল্লাহর রহমত লাভের অন্যতম উপায়।
শবে বরাত সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা পরিহার করুন:
১. শবে বরাতের নির্দিষ্ট কোনো নামাজ নেই – ১০০ রাকাত বা ১৪ রাকাত নামাজের কথা কোনো সহিহ হাদিসে পাওয়া যায় না।
২. আতশবাজি ও আনন্দ উৎসব শরিয়তসম্মত নয় – ইসলামে এর কোনো ভিত্তি নেই।
৩. মৃতদের আত্মা ঘরে ফিরে আসে—এমন বিশ্বাস ভুল – ইসলামে এর কোনো ভিত্তি নেই।
৪. এই রাতে বিশেষ কোনো খাবার খাওয়া বা বিতরণ করা জরুরি নয় – এটি বিদআত।
শবে বরাত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের রাত, যেখানে আল্লাহ বান্দাদের ক্ষমা করেন। তবে ভুল ধারণা ও বিদআত থেকে বিরত থাকা জরুরি।
আমাদের উচিত:
* সহিহ হাদিস অনুযায়ী ইবাদত করা
* আল্লাহর কাছে তওবা ও দোয়া করা
* বিদআত ও ভিত্তিহীন আমল পরিহার করা
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে শবে বরাতের বরকতপূর্ণ ইবাদত করার তওফিক দান করুন! আমিন।