আওয়ার টাইমস নিউজ।
ডেস্ক রিপোর্ট: দাউদ হায়দার ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাবনা জেলার অন্তর্গত একটি মফস্বল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মদিনটিই ছিল ভাষা আন্দোলনের মহান দিন, যেন ভবিষ্যতের জন্য একটি প্রতীকের মতো। ছোটবেলা থেকেই দাউদ হায়দার ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল, কল্পনাপ্রবণ এবং অনুসন্ধিৎসু। তাঁর শৈশব কেটেছে প্রকৃতির সান্নিধ্যে, তবে সেই পরিবেশে আধুনিক শিক্ষার সুযোগ খুব সহজ ছিল না।
গ্রামবাংলার বাস্তবতায় উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণ সহজ ছিল না। দাউদ হায়দারের পরিবার সম্পূর্ণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্গত ছিল, ফলে তাঁকে পড়ালেখার জন্য নানান আর্থিক কষ্ট ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। অল্প বয়স থেকেই লেখাপড়ার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল, কিন্তু আর্থিক অস্বচ্ছলতা এবং স্থানীয় মানসিকতার সীমাবদ্ধতা তাঁকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে বাধ্য করেছিল।
উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকায় আসেন। সেখানে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ঢাকায় আসার পর তাঁর জন্য শুরু হয় নতুন এক যুদ্ধ—নতুন পরিবেশে টিকে থাকা, জীবিকার সংগ্রাম চালিয়ে শিক্ষাজীবন বজায় রাখা। ছাত্রজীবন থেকেই দাউদ হায়দার সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তার লেখনির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। স্বাধীন চিন্তার এই প্রকাশ তাঁকে তখনকার সমাজে নানাভাবে কোণঠাসা করে।
তাঁর লেখায় মুক্তচিন্তা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মানবতার জয়গান প্রতিফলিত হত। তবে এই চিন্তাধারা তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে তাঁকে একঘরে করে তোলে।
দাউদ হায়দার মূলত কবিতা দিয়ে তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু করেন। তাঁর কবিতায় বেদনা, প্রেম, প্রতিবাদ, নিঃসঙ্গতা ও এক প্রকার তীব্র সমাজসচেতনতা ফুটে ওঠে। তিনি ছিলেন ভাষার কারিগর, শব্দের জাদুকর। খুব অল্প সময়ে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার এক গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন।
১৯৭৩ সালে তাঁর একটি কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তিনি তীব্র বিতর্কের মুখে পড়েন। কবিতার বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠে, যার ফলে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। পরে জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁকে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
দাউদ হায়দারের প্রবাস শুরু হয় জার্মানিতে। নতুন দেশে, নতুন ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে জীবন শুরু করা কোনো সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু তিনি দমে যাননি। প্রবাসে থেকেও বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা চালিয়ে গেছেন। তাঁর কবিতায় প্রবাসী জীবনের নিঃসঙ্গতা, শিকড় হারানোর বেদনা এবং নিজের দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
তিনি বার্লিনে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন এবং সেখানকার গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বাংলা সাহিত্য থেকে কখনো দূরে যাননি। প্রবাসে থেকেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বুকে ধারণ করে বেঁচে ছিলেন।
দাউদ হায়দার ২৫ এপ্রিল ২০২৫ সালে বার্লিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য হারায় এক সংগ্রামী কবিকে, যে সারা জীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম চালিয়ে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ ও বিশ্বজুড়ে সাহিত্য অনুরাগীদের মধ্যে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে।
দাউদ হায়দারের জীবন এক উজ্জ্বল উদাহরণ — কীভাবে সংগ্রাম, বিশ্বাস ও সৃষ্টিশীলতা মিলেমিশে একজন মানুষকে অমর করে তোলে। তিনি ছিলেন সাহসী কণ্ঠ, যিনি নিজের চিন্তা ও আদর্শের জন্য জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস — নিজের মাতৃভূমি — ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু কখনো
নিজের আদর্শকে বিসর্জন দেননি।