আওয়ার টাইমস্ নিউজ।
ইউক্রেনের দনবাস এলাকা রুশপন্থী গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা নিয়ে সাম্প্রতিক বিবাদে ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তের কাছে রাশিয়া তার সামরিক উপস্থিতি জোরদার করে ইউক্রেনকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের হুমকি দেয়ায় মস্কোর সাথে কিয়েভের চরম সামরিক উত্তেজনা বিরাজ করছে। আর এরই মাঝে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কির তুরস্ক সফরে চটেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও একনায়ক পুতিন। শনিবার ইস্তাম্বুলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সাথে জেলেনস্কি বৈঠকও করেছেন।
শুক্রবার রাতে পুতিন এরদোয়ানকে ফোন করে ইউক্রেন সংকট ও কৃষ্ণসাগরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। এরদোয়ান অবশ্য তাকে অভয় দেন যে, ইউক্রেনের সাথে সহযোগিতার অর্থ এ নয় যে, আঙ্কারা মস্কোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ইস্তাম্বুল বৈঠকে এরদোয়ান ও জেলেনস্কি শুল্কমুক্ত বাণিজ্য, পর্যটন ও ক্রীড়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দু দেশের মাঝে সহযোগিতা বাড়ানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। দু প্রেসিডেন্টের বৈঠকের পর, মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে বেশ কয়েকটি চুক্তিও হয়।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মাঝে সামরিক বর্ধিষ্ণু উত্তেজনায় তুরস্ক-নিয়ন্ত্রিত বসফরাস প্রণালী দিয়ে দুটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ কৃষ্ণসাগরে পৌঁছেছে। অবশ্য তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৪ঠা মে পর্যন্ত কৃষ্ণসাগরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ দুটি থাকবে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, কোনো পক্ষ না নিয়ে তুরস্ক এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ভূমিকা পালনের চেষ্টা করছে।
তবে কেউ কেউ এও ভাবছেন যে, রাশিয়ার সাথে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে জেলেনস্কির তুরস্ক সফর এবং এরদোয়ানের সাথে বৈঠকের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন ঠেকানো; পুতিনকে থামানো। কিন্তু অমুসলিম দেশ ইউক্রেনের মুসলিম দেশ তুরস্কের দ্বারস্থ হওয়ার কারণ কী? বেশ কিছু কারণ তো অবশ্যই রয়েছে; যেমন-
প্রথমত, প্রতিবেশী দু দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মাঝে বিবাদের সূত্রপাত ইউক্রেনের কৃষ্ণ সাগরে অবস্থিত ক্রিমিয়া উপদ্বীপ নিয়ে। রাশিয়া সেখানে কৃত্রিম বিপ্লব ঘটিয়ে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারীতে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী ও রুশ সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। ঐ বছর ১৫ই মার্চ প্রহসনের নির্বাচন করে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নিয়ে ১৮ই মার্চ ক্রিমিয়াকে নিজেদের ৮৫তম ফেডারেশন হিসেবে ঘোষণা করে রাশিয়া। এ নিয়ে ২৮শে মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় ১৯৩ সদস্য দেশের মাঝে ভোটাভুটির আয়োজন হয়। তাতে ১১টি সদস্য – আর্মেনিয়া, উঃ কোরিয়া, কিউবা, জিম্বাবুয়ে, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া, বেলারুশ, ভেনিজুয়েলা, রাশিয়া, সিরিয়া ও সুদান ক্রিমিয়ার রাশিয়াভুক্তিকে সমর্থন করে। এতে রাশিয়া ও বেলারুশ ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশ। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া, ইউক্রেন, ইন্দোনেশিয়া, আজারবাইজান, আলবেনিয়া, কাতার, কুয়েত, গ্রীস, জর্দান, জাপান, জার্মানী, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, দঃ কোরিয়া, নাইজেরিয়া, পর্তুগাল, ফিলিপাইন, ফ্রান্স, বৃটেন, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, লিবিয়া, সউদী আরব, সাইপ্রাস ও স্পেনসহ ১০০টি সদস্য বিপক্ষে ভোট দেয়, অর্থাৎ এরা ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ বলে মত দেয়। এ দলের পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী, রুমানিয়া, স্লোভাকিয়া ও মোলদাভিয়া ইউক্রেনের প্রতিবেশী। আফগানিস্তান, আর্জেন্টিনা, আলজেরিয়া, ইরাক, কাজাখস্তান, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, ভারত, মায়ানমার ও মিসরসহ ৫৮টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে এবং ইরান, ইসরাইল, ইয়েমেন, বসনিয়া-হার্জিগোভিনা, মরক্কো, লেবানন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ২৪টি সদস্য সভায় অনুপস্থিত থাকে। রাশিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ভালো হলেও ঐ ইস্যুতে তুরস্ক ইউক্রেনকে সমর্থন করেছে। কাজেই, নির্ভরযোগ্য ও মিত্র দেশ ভেবেই খুব সম্ভব জেলেনস্কি এরদোয়ানের শরণাপন্ন হয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, পুতিনকে এরদোয়ান যতোটা সফলভাবে ম্যানেজ করতে পারেন, আর কোনো শাসক তা পারেন বলে মনে হয় না বলেই দেশের এমন সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে জেলেনস্কি এরদোয়ানের পরামর্শ চাইতে সম্ভবত তুরস্ক এসেছেন।
তৃতীয়ত, নাগোর্নো-কারাবাখের সাম্প্রতিক যুদ্ধে তুরস্ক যেভাবে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজারবাইজানের পাশে থেকে দেশটির বিশাল বিজয়ে ভূমিকা রেখেছে, এ নিদানকালে জেলেনস্কি হয়তো তেমন কিছু একটা আশা নিয়েই তুরস্ক সফরে এসে থাকবেন। ইউক্রেন আজারবাইজানের মতো মুসলিম দেশ না হলেও কোনো দেশ তুরস্কের সাহায্যপ্রার্থী হলে, অন্তত এরদোয়ান সরকার তাকে ফিরিয়ে দেবে না।
চতুর্থত, ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের কোনো সীমান্ত নেই। কিন্তু জলপথে দু দেশের অবস্থান এপার-ওপার, অর্থাৎ কৃষ্ণ সাগরের উত্তরে ইউক্রেন আর দক্ষিণে তুরস্ক। কাজেই, তুরস্ক চাইলে, এ সমুদ্র পথে সহজেই ইউক্রেনকে যে কোনো সাহায্য করতে পারে।
পঞ্চমত, ইউরোপীয় দেশ হয়েও ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য নয়। অন্যদিকে, তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য। কাজেই, তুরস্কের মাধ্যমে ন্যাটো থেকে সামরিক সাহায্য পাওয়াটাই হয়তো জেলেনস্কির এ সফরের লক্ষ্য।
ষষ্ঠত, ইউরোপের সবচেয়ে গরীব দুটি দেশ হচ্ছে, মোলদাভিয়া ও ইউক্রেন। তা সত্ত্বেও ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেন ইউরোপে রাশিয়ার পর আয়তনে দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ এবং দেশটির সামরিক বাহিনী হচ্ছে, ইউরোপের তৃতীয় বৃহৎ সামরিক বাহিনী (রাশিয়া ও ফ্রান্সের পর)। তাই, রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে এরদোয়ানের বুদ্ধিমান শাসকের পরামর্শ অবশ্যই ইউক্রেনের কাম্য বলেই হয়তো জেলেনস্কির এ তুরস্ক সফর।
তবে কৃষ্ণ সাগরে দীর্ঘ মেয়াদে মার্কিন উপস্থিতি ইউক্রেনের জন্যে ভালো হলেও এরদোয়ান সরকারের জন্যে অবশ্যই ভালো নয়। কেননা, সেখান থেকে এ শয়তান পরাশক্তি তথা বাইডেন প্রশাসন তুরস্কের সেকুলারদের উসকে দিয়ে বিপ্লব বা অভ্যুত্থান কিংবা অন্য কোনোভাবে ইসলামপ্রেমী এরদোয়ান সরকারের পতন ঘটাতে চেষ্টার ত্রুটি করবে না। সূত্র: ডেইল সাবাহ ও নিজস্ব প্রতিবেদন।