আওয়ার টাইমস্ নিউজ।
ইসরাইল, অধিকৃত পশ্চিম তীর, মিশর ও জর্দানে তিনদিনের সফর শেষে বৃহস্পতিবার দেশে ফিরেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। দায়িত্ব নেয়ার পর, প্রথম মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়ে তিনি খোলাসা করেছেন যে, শান্তি আলোচনা নয়, বরং তার এ সফরের উদ্দেশ্য হলো – হামাস ও ইসরাইলের মাঝে যুদ্ধবিরতি চুক্তির দীর্ঘমেয়াদ নিশ্চিত করা।
সাংবাদিক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বাইডেন প্রশাসন ভাবছে – স্থবির হয়ে পড়া শান্তি আলোচনা শুরু করতে স্থিতিশীলতা জরুরি। আর তা নিশ্চিত করতে ব্লিঙ্কেন জেরুজালেম, রামাল্লাহ ও কায়রোতে প্রকাশ্যে ও গোপনে তার পরিকল্পনা এবং বিভিন্ন পক্ষের জন্যে শর্তাবলী তুলে ধরেছেন। প্রকাশ্যে তিনি যেটা বার বার বলছেন, তা হলো – আমেরিকা গাজার পুনর্গঠনে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনীদের পুনর্বাসনে পয়সা দেবে। কিন্তু তা থেকে হামাস কোনোভাবেই লাভবান হতে পারবে না, অর্থাৎ ঐ টাকা যেনো হামাসের হাতে না যায়। একই সাথে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চার বছরে যেভাবে ফিলিস্তিনী প্রশাসনকে অব্যাহতভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে; দুর্বল করা হয়েছে। এর পরিবর্তন চায় আমেরিকা।
এরই প্রমাণ দিতে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অধিকৃত পশ্চিম তীরের শহর রামাল্লাহতে ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সাথে বৈঠকের পর, ব্লিঙ্কেন ঘোষণা দেন যে, পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনীদের জন্যে মার্কিন যে কনস্যুলেট সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তা আবার খোলা হবে। সেই সাথে ওয়াশিংটনে ফিলিস্তিনী মুক্তি সংস্থা (পিএলও)-র অফিস খুলে দেয়া হবে। জানা গেছে, মাহমুদ আব্বাস মঙ্গলবারের বৈঠকে ব্লিঙ্কেনকে বলেছেন যে, আল-আকসা মসজিদ এলাকায় ইসরাইলের নতুন বিধিনিষেধ এবং পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনীদের উচ্ছেদের উদ্যোগ রাজনৈতিকভাবে তার জন্যে বড় ধরণের সংকট তৈরি করেছে। এগুলো বন্ধ করতে ইসরাইলের ওপর চাপ তৈরি করতে অনুরোধ করেছেন তিনি।
জেরুজালেমে মঙ্গলবার ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ব্লিঙ্কেন ফিলিস্তিনীদের ‘নিরাপত্তা’ ও ‘সমান মর্যাদা’ পাওয়ার অধিকারের কথা বলেছেন। রামাল্লায় মাহমুদ আব্বাসের সাথে বৈঠকের পর, তিনি বলেছেন যে, ফিলিস্তিনী আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে আমেরিকা প্রতিশ্রুত। এ বিষয়ে জেরুজালেমে সাংবাদিক হারিন্দার মিশ্র বলেন: ট্রাম্পের শাসনে গত চার বছর ধরে ওয়াশিংটনের যে সুর আমরা শুনেছি; আর মঙ্গলবার জেরুজালেম ও রামাল্লায় যা শুনেছি, তাতে এটা পরিষ্কার যে, বাইডেন প্রশাসন ফিলিস্তিনীদের কুড়াতে চায়। বলতে চায় যে, আমেরিকা নিরপেক্ষ একটি মধ্যস্থতাকারী; একচোখা নয়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গাজায় হামাসকে পুরাপুরি অবজ্ঞা করে কোণঠাসা করার যে সংকল্প বাইডেন সরকার করেছে, তা কতোটা বাস্তবসম্মত? ফিলিস্তিনী প্রশাসন ও মাহমুদ আব্বাসের হাত কতোটা শক্ত করা সম্ভব হবে? নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বাইডেনকে সাধারণ ফিলিস্তিনীরা কতোটা বিশ্বাস করবে? আর যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো – বাইডেনের এসব পরিকল্পনাকে ইসরাইল কতোটা পাত্তা দেবে?
লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্লেষক সাদী হামদী বলেন: ত্রাণের রাস্তা ধরে গাজায় হামাসের শক্তি খর্ব এবং সেখানে মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ ও ফিলিস্তিনী প্রশাসনের প্রভাব বাড়ানোর পথ ধরেছেন জো বাইডেন। যুদ্ধবিরতির পর থেকেই গাজায় পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনে অনেক টাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে আমেরিকা। কিন্তু বলা হচ্ছে, কোনোভাবেই এ টাকা হামাস ছুঁতে পারবে না বা এ থেকে হামাস লাভবান হতে পারবে না। আমেরিকা জানে, এ দাবি অবাস্তব। বাস্তবে ফিলিস্তিনী প্রশাসনের (পিএলও) কোনো ভিত্তিই আর গাজায় নেই। কিন্তু তাদের শর্তে হামাস রাজী না হলে, গাজার মানুষকে তারা বলতে পারবে যে, তাদের কল্যাণ নিয়ে হামাসের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের চিন্তা নিজেদের ক্ষমতা-প্রতিপত্তি। হামাস ইসরাইলকে প্রতিরোধের যে শক্তি অর্জন করেছে এবং এ লড়াইতে তার যে নমুনা দেখিয়েছে, তা নষ্ট করাই আমেরিকা ও ইসরাইলের এখন লক্ষ্য। ফিলিস্তিনীরা এখন আমেরিকাকে একবারেই বিশ্বাস করে না। বাইডেনকেও তারা ইসরাইলের সমর্থক হিসাবে দেখে। তারা ভয় পাচ্ছে, হামাসের শক্তি খর্ব করতে ত্রাণকে কৌশল হিসাবে নেয়ার পরিকল্পনা করছে আমেরিকা। স্থিতিশীলতার জন্যে ইসরাইল নয়, বরং ফিলিস্তিনীদের ওপরেই শুধু শর্ত চাপানো হচ্ছে।
হামাসের সাথে ইসরাইলের সবশেষ এ লড়াইয়ের শুরুর দিকে বাইডেন যেভাবে বার বার ইসরাইলের ‘আত্মরক্ষার অধিকারের’ কথা বলেছেন, তা নিয়ে ফিলিস্তিনীরা ক্ষিপ্ত। এরপর যুদ্ধবিরতির কথা বাইডেন তখনই বলেছেন – যখন দলের ভেতর থেকে তার ওপর চাপ বেড়েছে এবং মিশরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে যখন দুপক্ষ প্রায় রাজী হয়ে গেছে। তাদেরকে নিয়ে ফিলিস্তিনীদের বিশাল অংশের মাঝে এই যে অবিশ্বাস-সন্দেহ, তা মাথাব্যথার কারণ হবে আমেরিকার জন্য। সে সাথে ফিলিস্তিনীদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে যে ব্যক্তির শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা তারা করতে চাইছে, সেই মাহমুদ আব্বাসের গ্রহণযোগ্যতা – এমনকি পশ্চিম তীরেও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
হারিন্দর মিশ্র বলেন: পূর্ব জেরুজালেমে ইসরাইল নির্বাচন করতে দিচ্ছে না – এ যুক্তি দিয়ে মাহমুদ আব্বাস নির্বাচন স্থগিত করে দিলেন। কিন্তু সবাই জানে, নির্বাচন হলে তিনি হারবেন এবং পশ্চিম তীরেও হামাস জিতবে।
মাহমুদ আব্বাস ১৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনী প্রশাসনের (পিএলও) ক্ষমতায়। এ সময় পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনীরা দেখেছে যে, দিনকে দিন ইহুদি বসতি বাড়ছে এবং তাদের জায়গা কমছে। সে সাথে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা এবং তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগের কারণে আব্বাসের সমর্থন ক্রমাগত কমছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আল-আকসা মসজিদ ও পূর্ব জেরুজালেম থেকে ফিলিস্তিনী পরিবার উৎখাত নিয়ে ইসরাইলি প্রতিশোধের ঝুঁকি সত্ত্বেও যেভাবে হামাস হস্তক্ষেপ করেছে, তাতে সাধারণ ফিলিস্তিনীদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিঃসন্দেহে অনেক বেড়েছে।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর, আল-আকসা চত্বরে ফিলিস্তিনীদের উল্লাসে হামাসের একাধিক পতাকা দেখা গেছে। হামাসকে প্রশংসা করে শ্লোগান দেয়া হয়েছে। অথচ সেখানে মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ দলের কোনো পতাকা দেখা যায়নি! মাঠে ফিলিস্তিনীদের এ বাস্তবতা কতোটা বদলাতে পারবেন বাইডেন, তা অনিশ্চিত। আর এ বাস্তবতা বদলাতে ইসরাইলের সমর্থনওবা কতোটা পাবেন তিনি, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
এদিকে, হামাসের বিরুদ্ধে বিমান হামলা এবং সাধারণ ফিলিস্তিনীদের প্রাণহানি নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি হলেও ইসরাইলি জনগণের বিপুল সমর্থন ছিলো এ অভিযানের পেছনে। হামাসের রকেট হামলায় ইসরাইলে ১২ জনের মৃত্যু নিয়ে তৈরি হওয়া শোক এবং ক্রোধের রেশ না কাটতেই গাজায় কোটি কোটি ডলারের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আর জেরুজালেমে ফিলিস্তিনীদের জন্যে কনস্যুলেট খোলার ঘোষণা পছন্দ করছে না ইসরাইল।
ইসরাইলি নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে যে, মঙ্গলবারের বৈঠকে রামাল্লায় ফিলিস্তিনী প্রশাসনকে বাড়তি কিছু সাহায্য দিতে ব্লিঙ্কেনের একটি অনুরোধ ইসরাইল কার্যত নাকচ করে দিয়েছে। তারা বলেছে, তেমন সাহায্য তখনই সম্ভব যদি ফিলিস্তিনী এলাকায় ইসরাইলের সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ তদন্তে আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্তের প্রতি আব্বাস তার সমর্থন প্রত্যাহার করেন।
মঙ্গলবার দিনভর বৈঠকগুলো শেষ করে সন্ধ্যায় জেরুজালেমে ফিরে ব্লিঙ্কেন সাংবাদিকদের বলেছেন: ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনীদের মাঝে কিছুদিন পরপর সহিংসতার এ চক্রের পেছনের কারণগুলো দূর করতে চান প্রেসিডেন্ট বাইডেন। আমেরিকা কী বলছে, কার সাথে বলছে, কী করছে – এর গুরুত্ব অনেক।
কিন্তু এটাও সত্যি যে গত ৫০ বছরেও ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনীদের বিরোধের স্থায়ী একটি সুরাহা করে দিতে পারেনি আমেরিকা। বাইডেন যে পারবেন, তা নিয়ে বাজি ধরার ঝুঁকি সম্ভবত কেউই নেবেন না।
উল্লেখ্য, ফিলিস্তিনে ফাতাহ ও হামাস সবচেয়ে প্রভাবশালী ও প্রতিন্দ্বন্দ্বী দুটি দল। ফাতাহ একটি সেকুলার সংগঠন। এটা কখনো মধ্য বামপন্থী; কখনো বামপন্থী। এটার আদর্শ হচ্ছে – ফিলিস্তিনী জাতীয়তাবাদ, সামাজিক গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও দ্বি-জাতি তত্ত্ব। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ১৯৫৯ সালে ফাতাহ গঠিত হয়। ১৯৬৫ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসেরের অনুরোধে ফাতাহ নিজ অস্তিত্বের ঘোষণা দেয়। ফিলিস্তিনীদের ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই কেবল অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ড মুক্ত করা সম্ভব হবে বলে নাসের বিশ্বাস করতেন। তাই, তার নেতৃত্বাধীন মিশর ফাতাহকে অস্ত্র ও সামরিক উপকরণের যোগান দিতো। রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি ফাতাহ জনপ্রিয় গণপ্রতিরোধ আন্দোলনও গড়ে তোলে এবং দলটির সামরিক শাখার নাম দেয়া হয় ‘আস-সায়িক্বা’ বা “বজ্র”। এক পর্যায়ে ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনের অবিসংবাদী নেতায় পরিণত নয়। কিন্তু ১৯৯০ সালে সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখল করলে, আরাফাত সাদ্দামের পক্ষ নিয়ে মস্ত বড় ভুল করে বসেন! আর তখন থেকেই আরাফাতের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। ১৯৯১ সালে আমেরিকার নেতৃত্বে কুয়েত দখলমুক্ত হলে, কুয়েত সরকার সেদেশে আশ্রিত সকল ফিলিস্তিনীকে বহিস্কার করে। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির আগ পর্যন্ত ফাতাহ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ড মুক্ত করার নীতিতে অটল ছিলো। কিন্তু ‘সাদ্দামের কুয়েত দখল সমর্থন করলে, ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে সমস্যা কোথায়?’ মূলত এ যুক্তি দিয়ে পাশ্চাত্য জগৎ (ইউরোপ-আমেরিকা) আরাফাতকে কাবু করে ফেলে। ফলে, ইসরাইল সরকার ও পিএলও’র মাঝে ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি নামে তথাকথিত শান্তি চুক্তি হয়। এ চুক্তির মাধ্যমে পিএলও ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয়। ফলে, হামাস ইয়াসির আরাফাতকে ‘বেঈমান’ বলে ঘোষণা করে। এ চুক্তির পর থেকে ফাতাহ’র তৎপরতা শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং ফিলিস্তিন দখলমুক্ত করার সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে দলটি সরে আসে। এ চুক্তির পুরস্কার হিসেবে ১৯৯৪ সালে আরাফাত ইসরাইলের আইজ্যাক রবিন ও শিমন প্যারেজের সাথে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। ২০০৪ সালে আরাফাত মারা গেলে, ফাতাহ’র জনপ্রিয়তা আরো কমতে থাকে। মাহমুদ আব্বাসের যুগে ফাতাহ’র জনপ্রিয়তা তলানি গিয়ে ঠেকেছে।
অন্যদিকে, হামাস একটি ইসলামী সুন্নী সংগঠন – যা মূলত মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিনী সংস্করণ। দলটির আদর্শ হচ্ছে, মাতুরিদী-আশয়ারী, ফিলিস্তিনী জাতীয়তাবাদ, ইসলামবাদ, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, ইহুদিবিরোধিতা ও গণতন্ত্র। দলটি ১৯৮৭ সালে শেখ আহমদ ইয়াসীনের নেতৃত্বে গঠিত হয়। দলটির সশস্ত্র শাখার নাম ইজ্জুদ্দীন আল-কাসসাম ব্রিগেড; সংক্ষেপে আল-কাসসাম। ২০০৪ সালে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর, হামাস ও ফাতাহ’র সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং সেটা চরম আকার ধারণ করে ২০০৬ সালের জানুয়ারীতে ফিলিস্তিনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। ঐ নির্বাচনে হামাস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হয়, অর্থাৎ ১৩২টি আসনের মাঝে হামাস পায় ৭৪টি, ফাতাহ পায় ৪৫টি এবং বাকিগুলো পায় অন্যান্যে। এর প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনে সাহায্য বন্ধ করে দেয়! এরপর ২০০৭ সালে হামাস ফাতাহ সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীকে পরাজিত করে গাজার দখল নিয়ে নেয়। সেই থেকে গাজা শাসন করছে হামাস। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, কানাডা ও ইসরাইল হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করলেও রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, পাকিস্তান ও ইরান হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে না, বরং নেপথ্যে কমবেশি সহায়তা করে থাকে।
হামাসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসীন ১৯৮৭ সালে বলেছেন: হামাস সনদ ১৯৮৮ সালে নিশ্চিত করে যে, হামাস আধুনিক ইসরাইলসহ ফিলিস্তিনকে ইসরাইলি দখলমুক্ত করতে এবং বর্তমানে ইসরাইল, পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৪ সাল থেকে দলটি প্রায়ই বলে আসছে যে, ইসরাইল ১৯৬৭ সালের সীমান্তে সরে গিয়ে ক্ষতিপূরণ দিয়ে অঞ্চলগুলোতে অবাধ নির্বাচনের অনুমতি দিলে এবং ফিলিস্তিনী শরণার্থীদের ফিরে আসার অধিকার দিলেই কেবল তারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম বন্ধ করবে।
সম্প্রতি গাজা যুদ্ধে হামাস যেভাবে ইসরাইলে মুষলধারে রকেট হামলা চালিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তাতে ইসমাইল হানিয়ার নেতৃত্বে দলটি মুসলিম জাহানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আর ইহুদি লবি আতঙ্কিত হয়ে হামাসকে নিয়ে নতুন করে হিসেবে কষছে। এ যুদ্ধে নারী ও শিশুসহ ২৩২ জন ফিলিস্তিনী শহীদ হলেও হামাসের যোদ্ধা তুলনামূলকভাবে কমই শহীদ হয়েছেন। এ যুদ্ধে হামাস শিয়াদেরকে তথা ইরান ও ইয়েমেনের হুতিদেরকে যেভাবে পক্ষে নিতে পেরেছে, তা অনেকটাই বিস্ময়কর! শুধু তা-ই নয়, এ যুদ্ধে হামাস তার রাজনৈতিক মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহকেও পরোক্ষভাবে হলেও পক্ষে রাখতে পেরেছে। ফলে, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইসরাইল এ যুদ্ধে হামাস ও ফাতাহ’র দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে পুরোই ব্যর্থ হয়েছে – যা ইহুদি লবির জন্যে চরম হতাশাজনক। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন – হামাসের সাথে রূহানী সরকার ও হুতিদের সুসম্পর্ক গড়া এবং ফাতাহকে হামাসবিরোধিতা থেকে বিরত রাখার নেপথ্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান নেপথ্যে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। কেননা, হামাসের সাথে এরদোয়ানের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ ও চমৎকার। এরদোয়ান ও হানিয়া প্রায়ই বৈঠক করেন। আর চলতি যুদ্ধে রূহানীর সাথেও এরদোয়ান নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন; আবার ওদিকে পুতিনকেও পক্ষে রাখার চেষ্টা করেছেন। ফলে, যুদ্ধের এক পর্যায়ে রাশিয়া ইসরাইলকে হুমকিও দিয়েছে! সূত্র: বিবিসি, নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য।