
আওয়ার টাইমস নিউজ।
ডেস্ক রিপোর্ট: ভারত থেকে বাংলাদেশে জোরপূর্বক ‘পুশইন’ থামছেই না। গত ২২ দিনে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ১ হাজার ৫৩ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। এদের মধ্যে নারী, শিশু, এমনকি জাতিসংঘ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও রয়েছেন। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) বারবার প্রতিবাদ জানালেও এই অমানবিক কার্যক্রমে কোনো বিরতি নেই।
৪১ বছর বয়সী সেলিনা বেগম ও তার তিন মেয়ে সম্প্রতি ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। ভারতের ত্রিপুরার সাবরাং সীমান্ত দিয়ে বিএসএফ তাদের শরীরে খালি প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে গভীর রাতে ফেনী নদীতে ফেলে দেয়। তারা সারা রাত নদীতে ভেসে থেকে সকালে বাংলাদেশের স্থানীয়দের সহায়তায় উদ্ধার পান। বিজিবি সূত্রে জানা যায়, ২২ মে ভোরে রামগড়ের সোনাইপুল এলাকার কাছে সেলিনা, তার স্বামী উম্মেদ আলী এবং তিন কন্যা—রুমি (১৬), রুম্পা (১৫), ও সুমাইয়া (৬) নদী থেকে উদ্ধার হন।
এই পরিবারটি ভারতের হরিয়ানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিল। হরিয়ানার পুলিশ তাদের ধরে মোবাইল ফোন, টাকা কেড়ে নেয় এবং ট্রেনে করে কয়েক দফা গন্তব্য বদলে ত্রিপুরায় আনা হয়। পরে বিএসএফের একটি ক্যাম্পে নিয়ে তাদের শরীরে বোতল বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী জানান, তিনি গত ১০ বছর ভারতে ছিলেন। ১০ মে দিল্লি পুলিশ তাকে ও তার স্বামীকে আটক করে ৪৬ জনের সঙ্গে থানায় নিয়ে যায়। তিন দিন শুধু পানি দিয়ে রেখে পরে একটি বাসে করে সীমান্তের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। শেষ রাতে তাদের পুশইন করা হয়।
বিজিবির ডিজি মেজর জেনারেল মো. আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, “বারবার পতাকা বৈঠক ও কূটনৈতিক চ্যানেলে প্রতিবাদ জানানো হলেও পুশইন বন্ধ হয়নি। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।” তিনি জানান, অনেকেই বছরের পর বছর ভারতে ছিলেন, তাদের সন্তানরাও সেখানে জন্মেছে। কিন্তু পুশইনের আগে তাদের নথিপত্র জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিজিবি বিষয়টি আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সমাধানের জন্য স্বচ্ছ প্রক্রিয়া চায়।
তিনি আরও জানান, ৭ মে পাঁচজন রোহিঙ্গা, যারা ইউএনএইচসিআর-নিবন্ধিত, তাদেরও ভারত থেকে জোর করে কুড়িগ্রামের সীমান্ত দিয়ে পাঠানো হয়েছে।
বিজিবির বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, ৭ মে থেকে এখন পর্যন্ত ভারত থেকে ১,০৫৩ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পুশইন হওয়া সংখ্যা:
মৌলভীবাজার: ৩৩১ জন
খাগড়াছড়ি: ১১১ জন
সিলেট: ১০৩ জন
কুড়িগ্রাম: ৮৪ জন
লালমনিরহাট: ৭৫ জন
সুন্দরবনের দুর্গম মান্দারবাড়ীয়া: ৭৮ জন (তাদের মধ্যে ৩ জন রোহিঙ্গা)
ঝিনাইদহ: ৪২ জন
ফেনী: ৩৯ জন
পঞ্চগড়: ৩২ জন
মেহেরপুর: ৩০ জন
সাতক্ষীরা: ২৩ জন
হবিগঞ্জ: ১৯ জন
চুয়াডাঙ্গা: ১৯ জন
ঠাকুরগাঁও: ১৯ জন
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ১৭ জন
সুনামগঞ্জ: ১৬ জন
কুমিল্লা: ১৩ জন
দিনাজপুর: ২ জন
এদিকে, গোমস্তাপুরের বিভিষণ সীমান্ত দিয়ে পুশইন হওয়া ১৭ জনকে পুলিশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে। তাদের মধ্যে ৯ শিশু, ৪ নারী এবং ৪ পুরুষ রয়েছে। অন্যদিকে সুনামগঞ্জের ছাতক সীমান্ত দিয়ে ১৬ জনকে আটক করে থানায় হস্তান্তর করা হয়।
লালমনিরহাটেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে যখন এক রাতেই ৫৭ জনকে পুশইনের চেষ্টা করে বিএসএফ। কিন্তু বিজিবি ও স্থানীয়দের তৎপরতায় তারা ব্যর্থ হয়। পরে পতাকা বৈঠকে এসব ব্যক্তিদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হলেও বিএসএফ শূন্যরেখায় ফেলে রেখে চলে যায়, যা নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, “এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত।”
এই একতরফা এবং অমানবিক পুশইন কার্যক্রম শুধু আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনই নয়, বরং একটি মানবিক সংকটও সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ কূটনৈতিক ও সামরিক উভয় পর্যায়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে, কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এমন আচরণ ভবিষ্যতের জন্য বড় আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে।