
আওয়ার টাইমস নিউজ।
মনোবিজ্ঞান ডেস্ক: বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির ভয়াবহ, এ ফেতনা-ফাসাদের যুগে, রাত্রির নীরবতায় যখন আমরা শুয়ে পড়ি, তখন আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন ধ্বংসকারী মোবাইল ইন্টারনেটের চমৎকার জগৎ যেন এক অতল গহ্বরে পরিণত হয়।
কিন্তু আধুনিক এই প্রযুক্তির মায়াজালে লিপ্ত হয়ে, আপনি কি কখনো ভেবেছেন- আপনার কলিজার টুকরো সন্তানের মস্তিষ্কে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে? আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণায় স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে যে, মোবাইল ইন্টারনেটের অপব্যবহারের ফলে শিশু-কিশোরদের মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যেসব শিশু-কিশোর নিয়মিত মোবাইল ব্যবহার করছে, তাদের আচরণে ব্যাপকভাবে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যেমন: পড়াশোনায় একেবারেই মনোযোগী না হওয়া, পড়া মুখস্ত না হওয়া, অল্পতেই প্রচণ্ড রেগে যাওয়া, ভাঙচুর করা, মা-বাবার সাথে চিৎকার-চেচামেচি করে গালাগাল করা-এসব আচরণ মোবাইলের অপব্যবহারের ফলেই ঘটছে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
রাতের অন্ধকারে যখন আমাদের শিশুদের স্ক্রিনের নীল আলো তাদের চোখে পড়ে, তখন তাদের দেহে মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণ ব্যাহত হয়। এই হরমোনটি ঘুম নিয়ন্ত্রণ ও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। যখন মেলাটোনিনের নিঃসরণ বাধাগ্রস্ত হয়, তখন তাদের ঘুমের চক্র ভেঙ্গে যায়, ফলে ঘুমের অভাবে মস্তিষ্কের কোষগুলো পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায় না। এতে দীর্ঘমেয়াদে স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ এবং শিখন ক্ষমতা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে যে, রাত জেগে মোবাইল ব্যবহারের ফলে শুধুমাত্র শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে প্রভাব পড়ে না, বরং এতে আচরণগত সমস্যাও দেখা দেয়। অনিয়মিত ঘুম, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম ও অনবরত ইন্টারনেট ব্যবহার শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ, চাপ ও অতিরিক্ত মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। ফলস্বরূপ, তাদের সামাজিক ও স্কুল জীবনে মনোযোগ হারানোর পাশাপাশি, দীর্ঘমেয়াদে মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
আপনার সন্তানের মস্তিষ্কের উন্নয়ন প্রতিনিয়ত চলছে। প্রতিটি ঘুম, প্রতিটি বিশ্রাম সঠিকভাবে পাওয়া তাদের ভবিষ্যতের ভিত্তি। তবে, রাত জেগে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারে এই প্রাকৃতিক বিকাশে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। একজন অভিভাবক হিসেবে আপনাকে প্রশ্ন করতে হবে, আপনি কি সত্যিই চান আপনার সন্তান এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াক?
সচেতনতা ও প্রতিরোধের আহ্বান।
নিয়মিত ঘুম: শিশুকে নিয়মিত ও পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন।
স্ক্রিন টাইম সীমিত করুন: বিশেষ করে রাতে, মোবাইল ও ট্যাবলেট ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করুন।
বিকল্প কার্যক্রম: খেলাধুলা, বিভিন্ন ইসলামিক বই ও শিক্ষনীয় গল্পের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং পাশাপাশি সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে তাদেরকে উৎসাহিত করুন।
আমরা সবাই কমবেশি জানি যে, তথ্যপ্রযুক্তির এই আধুনিক যুগে কিছু সুবিধা থাকলেও এর কিছু ভয়াবহ নিন্দনীয় দিকও রয়েছে। তাই, এই অদৃশ্য বিপদ থেকে আপনার সন্তানকে বাঁচাতে এখনই সচেতন হয়ে পদক্ষেপ নিন। ভবিষ্যতের জন্য তাদের মস্তিষ্ককে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব শুধুমাত্র আমাদেরই, অভিভাবকদের।
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন:
كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ رَهِينَةٌ
“প্রত্যেক প্রাণ তার অর্জিত কর্ম অনুযায়ী বাধ্য।”
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট করে বলেছেন যে, প্রতিটি ব্যক্তি তার জীবনের প্রতিটি কর্মের জন্য দায়বদ্ধ। অর্থাৎ, আমাদের সব কাজ ও কর্মফলই আমাদের জন্য ভবিষ্যতে হিসাবের কারণ হবে। প্রতিটি কাজ, ভালো বা মন্দ, আমরা যা অর্জন করি, তা আমাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের প্রতিদিনের কর্মযত্ন ও নৈতিক দায়িত্ব পালনই আল্লাহর নিকট আমাদের আসল পরিমাপ হবে।
রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন:
“كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته”
“প্রত্যেকটি ব্যক্তি একজন পালক এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তার পালকের প্রতি দায়বদ্ধ।”
এই হাদিসটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, প্রতিটি মা-বাবা তাদের সন্তানদের প্রতি এক বিশেষ দায়িত্বভার বহন করেন। শুধুমাত্র শারীরিক সুরক্ষা কিংবা খাদ্য-পরিষেবা প্রদানই নয়, বরং তাদের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও মানসিক বিকাশের প্রতি লক্ষ্য রেখে যথাযথ দিকনির্দেশনা ও আদর্শ আচরণের শিক্ষা প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। আল্লাহর নিকট এই দায়িত্বের জবাবদিহিতার প্রশ্ন উঠবে—”আপনি আপনার সন্তানের সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন কি?”
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন, প্রত্যেক মা-বাবাকে জিজ্ঞাসা করবেন, “সন্তানদের জন্য তুমি কি করেছো?” এই আয়াত ও হাদিস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সন্তানদের সঠিক লালন-পালন ও শিক্ষা প্রদান করাই একজন মা-বাবার আসল দায়িত্ব। তাই, প্রতিটি মা-বাবাকে সচেতন হয়ে, তাদের সন্তানদেরকে সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে, যেন তারা আল্লাহর নিকটেই প্রশংসিত ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আপনার সন্তানের দুনিয়া ও আখের জীবনকে সুন্দর এবং সুখময় করতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করুন, সচেতন হোন- কারণ আপনার সন্তানের সফল ভবিষ্যৎ আপনাকে আল্লাহর জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।
মহান আল্লাহ আমাদের এই কথাগুলোর উপর আমল করার তৌফিক দান করুন, আমীন।
______________________________________________
লেখক: বিশিষ্ট কলামিস্ট ও ইসলামিক গবেষক
হুসাইন আল আজাদ ইবনে নোয়াব আলী।