
আওয়ার টাইমস নিউজ।
হজ্ব-ওমরায় গেলে আমরা সেখান থেকে কী নিয়ে ফিরব? কদিন আগে আমার সন্তানদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। অনেক বন্ধুও মাঝেমধ্যে এ ধরনের প্রশ্ন করে থাকেন। তাই মনে হল, আরও কিছু প্রয়োজনীয় কথাসহ ওই আলোচনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরি।
আবদ ও আবিদ হয়ে ফিরে আসা
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, এই সফরের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কোনো না কোনো ইবাদত আদায় হয়ে থাকে। চাই তা ফরয, সুন্নত কিংবা নফল ইবাদতই হোক না কেন। তাই একজন মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য ও আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে যে, সে আল্লাহর ঘর থেকে আল্লাহ তাআলার ইবাদতগোযার বান্দা হয়ে ফিরে আসবে!
آَئِبُوْنَ تَائِبُوْنَ لِرَبِّنَا حَامِدُوْنَ.
অর্থ : হে আল্লাহ! আপনার হামদ ও শোকর আদায় করতে করতে পুনরায় আপনার দরবারেই আমরা ফিরে আসছি।
আমি সন্তানদেরকে এবং বন্ধুদেরকেও বলেছি যে, হজ্ব ও ওমরা শেষে সঙ্গে করে কী আনবেন-তা জানতে হলে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করুন, হাদীস ও সীরাতের কিতাব থেকে হজ্বের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট অধ্যয়ন করুন, আকাবিরের হজ্বের ঘটনাবলি পাঠ করুন। বাইতুল্লাহ এবং হজ্বের অন্যান্য শাআয়ের ও মাশায়ের যে সকল মহাপুরুষের ত্যাগ ও কুরবানীর সাক্ষ্য বহন করছে, কুরআন মাজীদে তাঁদের অবস্থা ও বৈশিষ্ট্যাবলি পড়তে থাকুন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হজ্বের বিবরণ পাঠ করুন, তাঁর সাথে যারা হজ্ব করেছেন তাদের ঘটনাবলি জানুন। তাহলে ইনশাআল্লাহ সহজেই বুঝতে পারবেন, হজ্বের শিক্ষা কী এবং সেখান থেকে কী আনতে হবে। এই নিবন্ধে শুধু মৌলিক কিছু শিক্ষার দিকে ইঙ্গিত করা হল।
১. তাওহীদ ও ঈমান-ইয়াকীন
তাওহীদের পূর্ণতা ও ঈমান-ইয়াকীনের দৃঢ়তা হজ্বের প্রথম ও চূড়ান্ত শিক্ষা। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক… থেকে শুরু করে বিদায় তাওয়াফ পর্যন্ত হজ্বের প্রতিটি আমল এ সাক্ষ্যেরই মূর্ত রূপ যে, আমাদের তাওহীদ শুধু বিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং আকীদা ও বিশ্বাসের সীমা অতিক্রম করে তা আমাদের কর্ম ও আচরণে, আমাদের চরিত্র, ব্যবহার ও চালচলনে মিশে গিয়েছে।
কা‘বার নির্মাতা, তাওহীদের ইমামের আচরণ-উচ্চারণ তো এই ছিল।
اِنِّیْ وَجَّهْتُ وَجْهِیَ لِلَّذِیْ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ حَنِیْفًا وَّ مَاۤ اَنَا مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ.
আমি সম্পূর্ণ একনিষ্ঠভাবে সেই সত্তার দিকে নিজের মুখ ফেরালাম, যিনি আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি শিরককারীদের অন্তভুর্ক্ত নই। —সূরা আনআম (৬) : ৭৯
তদ্রূপ :
قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ،لَا شَرِیْكَ لَهٗ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنََ.
বলে দাও, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার ইবাদত, আমার জীবন, আমার মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক…। —সূরা আনআম (৬) : ১৬২-১৬৩
তাওহীদ পূর্ণ হয় মূলত আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মহব্বতের পরিপূর্ণতা ও নিসবতে ইহসান অর্জনের মাধ্যমে। আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো হজ্ব ও ওমরায় এই দুটি জিনিসেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
ঈমান ও ইয়াকীন মজবুত করার জন্য হারামের সীমানায় প্রবেশ করার সময় হাজেরা রা.-এর ইয়াকীনপূর্ণ ঐ বাক্য স্মরণ করাই যথেষ্ট, যা তাঁর পাক যবানে উচ্চারিত হয়েছিল এক কঠিন মুহূর্তে। ইবরাহীম আ. যখন তাঁকে ও তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈলকে তৃণলতাহীন, জনমানবশূন্য মরুপ্রান্তরে উপায়—উপকরণহীন নিঃস্ব অবস্থায় রেখে যাচ্ছিলেন তখন হাজেরা রা. একথা জানতে পেরে যে, আল্লাহ তাআলার নির্দেশেই তিনি এমনটি করছেন, অত্যন্ত নিশ্চিন্ত মনে দৃঢ়তাপূর্ণ ঐতিহাসিক বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন।
اِذًا لَا يُضَيِّعُنَا
(আল্লাহ তাআলাই আমাদের অভিভাবক।) সুতরাং তিনি আমাদের ধ্বংস করবেন না। —আসসুনানুল কুবরা, নাসায়ী, হাদীস ৮৩২০; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৪০৬৪
২. আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ
মুমিনের বৈশিষ্ট্যই হল আনুগত্য ও সমর্পণ। এজন্যই তার অপর নাম মুসলিম। হজ্বের বিধিবিধানই এমন যে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো আমলে এই সমর্পণেরই অনুশীলন চলে। উপরন্তু কোনো হজ্ব বা ওমরাকারী যদি কাবাগৃহের নির্মাতা ইবরাহীম ও ইসমাঈল আ.-এর অবস্থা স্মরণ রাখেন তাহলে তিনি হজ্ব থেকে আনুগত্য ও সমর্পণের শিক্ষা গ্রহণ না করে ফিরতে পারেন না।
اِذْ قَالَ لَهٗ رَبُّهٗۤ اَسْلِمْ قَالَ اَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعٰلَمِیْنَ،وَ وَصّٰی بِهَاۤ اِبْرٰهٖمُ بَنِیْهِ وَ یَعْقُوْبُ یٰبَنِیَّ اِنَّ اللهَ اصْطَفٰی لَكُمُ الدِّیْنَ فَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَ اَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ.
মেয়ের ব্যক্তি নিজেকে নির্বোধ সাব্যস্ত করেছে, সে ছাড়া আর কে ইবরাহীমের পথ পরিহার করে? বাস্তবতা তো এই যে, আমি দুনিয়ায় তাকে (নিজের জন্য) বেছে নিয়েছি আর আখেরাতে সে সৎকর্মশীলদের অন্তভুর্ক্ত হবে। যখন তাঁর প্রতিপালক তাঁকে বললেন, ‘আনুগত্যে নতশির হও’, তখন সে (সঙ্গে সঙ্গে) বলল, আমি রাব্বুল আলামীনের (প্রতিটি হুকুমের) সামনে মাথা নত করলাম। —সূরা বাকারা (২) : ১৩০-১৩২
পিতা-পুত্রের কুরবানী, আসমানী মহাপরীক্ষা এবং তাঁদের সফলতার বিবরণ।
وَ قَالَ اِنِّیْ ذَاهِبٌ اِلٰی رَبِّیْ سَیَهْدِیْنِ، رَبِّ هَبْ لِیْ مِنَ الصّٰلِحِیْنَ،فَبَشَّرْنٰهُ بِغُلٰمٍ حَلِیْمٍ،فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْیَ قَالَ یٰبُنَیَّ اِنِّیْۤ اَرٰی فِی الْمَنَامِ اَنِّیْۤ اَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَا ذَا تَرٰی قَالَ یٰۤاَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ؗ سَتَجِدُنِیْۤ اِنْ شَآءَ اللهُ مِنَ الصّٰبِرِیْنَ،فَلَمَّاۤ اَسْلَمَا وَ تَلَّهٗ لِلْجَبِیْنِ، وَ نَادَیْنٰهُ اَنْ یّٰۤاِبْرٰهِیْمُ، قَدْ صَدَّقْتَ الرُّءْیَا اِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِی الْمُحْسِنِیْنَ، اِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْبَلٰٓؤُا الْمُبِیْنُ،وَ فَدَیْنٰهُ بِذِبْحٍ عَظِیْمٍ، وَ تَرَكْنَا عَلَیْهِ فِی الْاٰخِرِیْنَ،سَلٰمٌ عَلٰۤی اِبْرٰهِیْمَ،كَذٰلِكَ نَجْزِی الْمُحْسِنِیْنَ،اِنَّهٗ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِیْنَ.
ইবরাহীম বলল, আমি আমার প্রতিপালকের কাছে যাচ্ছি। তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এমন পুত্র দান কর, যে হবে সৎ লোকদের একজন। সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে পুত্র যখন ইবরাহীমের সাথে চলাফেরা করার উপযুক্ত হল, তখন সে বলল, বাছা! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যবেহ করছি। এবার চিন্তা করে বল, তোমার অভিমত কী? পুত্র বলল, আব্বাজী! আপনাকে যার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে আপনি সেটাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে সবরকারীদের একজন পাবেন। সুতরাং (সেটা ছিল এক বিস্ময়কর দৃশ্য) যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিল। আর আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। নিশ্চয়ই আমি সৎকর্মশীলদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। এবং আমি এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে সে শিশুকে মুক্ত করলাম। এবং যারা তার পরবতীর্কালে এসেছে তাদের মধ্যে এই ঐতিহ্য চালু করেছি যে, (তারা বলবে) সালাম হোক ইবরাহীমের প্রতি, আমি সৎকর্মশীলদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই সে আমার মুমিন বান্দাদের অন্তভুর্ক্ত ছিল। —সূরা সাফফাত (৩৭) : ৯৯—১১১
৩. ধৈর্য, অবিচলতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা
শুধু ইসমাঈল আ.-এর কুরবানী ও সম্পর্কের ঘটনা থেকেই ধৈর্য ও অবিচলতা এবং ত্যাগ ও আত্মত্যাগের শিক্ষা লাভ করা সম্ভব।
তিনি বলেছিলেন,
দলীল-প্রমাণ জানার প্রয়োজন মনে হলে মাওলানা আবদুল মতীন ছাহেব সংকলিত ‘দলীলসহ নামাযের মাসায়েল’ (প্রকাশক—মাকতাবাতুল আযহার বাড্ডা) ও শায়েখ ইলিয়াস ফয়সালের ‘নামাযে পয়াম্বর’ (বাংলা অনুবাদ : নবীজীর নামায, প্রকাশক—মাকতাবাতুল আশরাফ বাংলাবাজার) কিতাব দুটি মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করুন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের হারামাইনকে হেফাযত করুন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসকে তাওহীদপন্থীদের হাতে ফিরিয়ে দিন আর হারামাইন ও বাইতুল মুকাদ্দাসের পবিত্রতা দ্বারা আমাদেরকে পূতঃপবিত্র করে দিন— আমীন।
লেখক: মাওঃ আব্দুল মালেক
বিশিষ্ট ইসলামের লেখক গবেষক।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় মাসিক পত্রিকা আল কাউসার থেকে লিখাটি সংগৃহীত।